WELCOME TO MY BLOG "সনাতন বৈদিক ধর্ম" AND SEE SOMETHING NEW

Friday, July 3, 2020

শ্রী কৃষ্ণের বহুবিবাহ একটি ভ্রান্ত ধারণা

কৃষ্ণ রুক্মিণীকে পূর্বে বিবাহ করিয়াছিলেন, এক্ষণে এক  সম্যন্তক মণির প্রভাবে আর দুটি ভার্যা জাম্ববতী এবং সত্যভামা, লাভ করিলেন। ইহাই বিষ্ণুপুরাণ লেন, হরিবংশ এক পৈঠা উপর গিয়া থাকেন,—তিনি বলেন, দুইটি না, চারিটি। সত্রাজিতের তিনটি কন্যা ছিল,—সত্যভামা, প্রস্বাপিনী এবং ব্রতিনী। তিনটিই তিনি শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলেন। কিন্তু দুই চারিটায় কিছু আসিয়া যায় না—মোট সংখ্যা নাকি ষোল হাজারের উপর। এইরূপ লোকপ্রবাদ।

বিষ্ণুপুরাণে ৪ অংশে আছে, “ভগবতোহ'প্যত্র মর্ত্যলোকেহবতীর্ণস্য ষোড়শসহস্রাণ্যেকোত্তরশতা—ধিকানি স্ত্রীণামভবন্।”- বিষ্ণুপুরাণ, ৪ অং, ১৫ অ, ১৯।
  কৃষ্ণের ষোল হাজার এক শত এক স্ত্রী।
 কিন্তু ঐ পুরাণের ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে প্রধানাদিগের নাম করিয়া পুরাণকার বলিতেছেন, রুক্মিণী ভিন্ন “অন্যাশ্চ ভার্যাঃ কৃষ্ণস্য বভূবুঃ সপ্ত শোভনাঃ।” তার পর, “ষোড়শাসন্ সহস্রাণি স্ত্রীণামন্যানি চক্রিণঃ।” তাহা হইলে, দাঁড়াইল ষোল হাজার সাত জন। ইহার মধ্যে ষোল হাজার নরককন্যা। সেই আষাঢ়ে গল্প বলিয়া আমি ইতিপূর্বেই বাদ দিয়াছি।
গল্পটা কত বড় আষাঢ়ে, আর এক রকম করিয়া বুঝাই। বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ অংশের ঐ পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে যে, এই সকল স্ত্রীর গর্ভে কৃষ্ণের এক লক্ষ আশী হাজার পুত্র জন্মে। বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কৃষ্ণ এক শত পঁচিশ বৎসর ভূতলে ছিলেন। হিসাব করিলে, কৃষ্ণের বৎসরে ১৪৪০টি পুত্র, ও প্রতিদিন চারিটি পুত্র জন্মিত। এ স্থলে এইরূপ কল্পনা করিতে হয় যে, কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছায় কৃষ্ণমহিষীরা পুত্রবতী হইতেন।
এই নরকাসুরের ষোল হাজার কন্যার আষাঢ়ে গল্প ছাড়িয়া দিই কিন্তু তদ্ভিন্ন আট জন “প্রধানা” মহিষীর কথা পাওয়া যাইতেছে। এক জন রুক্মিণী।বিষ্ণুপুরাণকার বলিয়াছেন, আর সাত জন। কিন্তু ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে নাম দিতেছেন আট জনের, যথা—

“কালিন্দী মিত্রবিন্দা চ সত্যা নাগ্নজিতী তথা।
দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিণী ||
মদ্ররাজসুতা চান্যা সুশীলা শীলমণ্ডনা।
সাত্রাজিতী সত্যাভামা লক্ষ্মণা চারুহাসিনী ||”

১।
কালিন্দী
৫।রোহিণী (ইনি কামরূপিণী)
২।মিত্রবিন্দা
৬।মদ্ররাজসুতা সুশীলা
৩।নগ্নজিৎকন্যা সত্যা
৭।সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৪।জাম্ববতী
৮।লক্ষ্মণা

রুক্মিণী লইয়া নয় জন হইল। আবার ৩২ অধ্যায়ে আর এক প্রকার। কৃষ্ণের পুত্রগণের নামকীর্তন হইতেছে:—
প্রদ্যুম্নাদা হরেঃ পুত্রা রুক্মিণ্যাঃ কথিতাস্তব।
ভানুং ভৈমরিকঞ্চৈব সত্যাভামা ব্যজায়ত || ১||
দীপ্তিমান্ তাম্রপক্ষাদ্যা রোহিণ্যাং তনয়া হরেঃ।
বভূবুর্জাম্বুবত্যাঞ্চ শাম্বাদ্যা বাহুশালিনঃ || ২||
তনয়া ভদ্রবিন্দাদ্যা নাগ্নজিত্যাং মহাবলাঃ।
সংগ্রামজিৎপ্রধানাস্তু শৈব্যায়াস্ত্বভবন্ সুতাঃ || ৩||
বৃকদ্যাস্তু সুতা মাদ্র্যাং গাত্রবৎপ্রমুখান্ সুতান্।
অবাপ লক্ষ্মণা পুত্রাঃ কালিন্দ্যাঞ্চ শ্রুতাদয়ঃ || ৪||
এই তালিকায় পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
১।সত্যভামা (৭)
৫।শৈব্যা (২)
২।রোহিণী (৫)
৬।মাদ্রী (৬)
৩।জাম্ববতী (৪)
৭।লক্ষ্মণা (৮)
৪।নাগ্নজিতী (৩)
৮।কালিন্দী (১)
কিন্তু ৪র্থ অংশের ‍১৫ অধ্যায়ে আছে, “তাসাঞ্চ রুক্মিণী-সত্যভামাজাম্ববতী-জালহাসিনীপ্রমুখা অষ্টৌ পত্ন্যঃ প্রধানাঃ।” এখানে আবার সব নাম পাওয়া গেল না, নূতন নাম “জালহাসিনী” একটা পাওয়া গেল। এই গেল বিষ্ণুপুরাণে। হরিবংশে আরও গোলযোগ।

হরিবংশে আছে;—
মহিষীঃ সপ্ত কল্যাণীস্ততোহন্যা মধুসূদনঃ।
উপষেমে মহাবাহুর্গুণোপেতাঃ কুলোদ্গতাঃ ||
কালিন্দীং মিত্রবিন্দাঞ্চ সত্যাং নাগ্নজিতীং তথা।
সুতাং জাম্ববতশ্চাপি রোহিনীং কামরূপিণীম্ ||
মদ্ররাজসুতাঞ্চাপি সুশীলাং ভদ্রলোচনাম্।
সাত্রাজিতীং সত্যভামাং লক্ষ্মণাং জালহাসিনীম্।
শৈব্যস্য চ সুতাং তম্বীং রূপেণাপ্সরসাং সমাং ||
               ১১৮ অধ্যায়ে, ৪০-৪৩ শ্লোকঃ।
এখানে পাওয়া যাইতেছে যে, লক্ষ্মণাই জালহাসিনী। তাহা ধরিয়াও পাই,—
১।কালিন্দী

৫।রোহিণী
২।মিত্রবিন্দী

৬।মাদ্রী সুশীলা
৩।সত্যা

৭।সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৪। জাম্ববৎ-সুতা

৮।জালহাসিনী লক্ষ্মণা


৯)শৈব্যা


ক্রমেই শ্রীবৃদ্ধি-রুক্মিণী ছাড়া নয় জন হইল। এ গেল ১১৮ অধ্যায়ের তালিকা। হরিবংশে আবার ১৬২ অধ্যায়ে আর একটি তালিকা আছে, যথা—
অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।
সর্বা বীরপ্রজাশ্চৈব তাস্বপত্যানি মে শৃণু ||
রুক্মিণী সত্যভামা চ দেবী নাগ্নজিতী তথা।
সুদত্তা চ তথা শৈব্যা লক্ষ্মণ জালহাসিনী ||
মিত্রবিন্দা চ কালিন্দী জাম্ববত্যথ পৌরবী।
সুভীমা চ তথা মাদ্রী    *    *    *
ইহাতে পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
(১)সত্যভামা

(৬)মিত্রবিন্দা
(২)নাগ্নজিতী

(৭)কালিন্দী
(৩)সুদত্তা

(৮)জাম্ববতী
(৪)শৈব্যা

(৯)পৌরবী
(৫)লক্ষ্মণা জালহাসিনী

(১০)সুভীমা


(১১)মাদ্রী

হরিবংশকার ঋষি ঠাকুর, আট জন বলিয়া রুক্মিণী সমেত বার জনের নাম দিলেন। তাহাতেও ক্ষান্ত নহেন। ইহাদের একে একে সন্তানগণের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন আবার বাহির হইল—
(১২)সুদেবা।

(১৪)কৌশিকী
(১৩)উপাসঙ্গ

(১৫)সুতসোমা


(১৬)যৌধিষ্ঠিরী। (
ইঁহারাও প্রধানা অষ্টের ভিতর গণিত হইয়াছেন। ‘তাসামপত্যান্যষ্টানাং ভগবন্ প্রব্রবীতে মে।’ ইহার উত্তরে এ সকল মহিষীর অপত্য কথিত হইতেছে।)


এছাড়া পূর্বে সত্রাজিতের আর দুই কন্যা ব্রতিনী এবং প্রস্বাপিনীর কথা বলিয়াছেন।

এ ছাড়া মহাভারতের নূতন দুইটি নাম পাওয়া যায়—গান্ধারী ও হৈমবতী। 
             রুক্মিণী ত্বথ গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতীত্যপি।
          দেবী জাম্ববতী চৈব বিবিশুর্জাতবেদসম্ ||
                     মৌসলপর্ব, ৭ অধ্যায়।

সকল নামগুলি একত্র করিলে, প্রধানা মহিষী কতকগুলি হয় দেখা যাউক। মহাভারতে আছে,—
(১)রুক্মিণী
(৪)শৈব্যা
(২)সত্যভামা
(৫)হৈমবতী
(৩)গান্ধারী
(৬)জাম্ববতী
মহাভারতে আর নাম নাই, কিন্তু “অন্যা” শব্দটা আছে। তার পর বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে ১, ২, ৩, ছাড়া এই কয়েকটা নামও পাওয়া যায়।
(৭)কালিন্দী
(১০)রোহিণী
(৮)মিত্রবিন্দা
(১১)মাদ্রী
(৯)সত্যা নাগ্নজিতী
(১২)লক্ষ্মাণা জালহাসিনী
বিষ্ণুপুরাণের ৩২ অধ্যায়ে তদতিরিক্ত পাওয়া যায়, শৈব্যা। তাঁহার নাম উপরে লেখা আছে। তার পর হরিবংশের প্রথম তালিকা ১১৮ অধ্যায়ে, ইহা ছাড়া নূতন নাম নাই, কিন্তু ১৬২ অধ্যায়ে নূতন পাওয়া যায়।
(১৩)কালিন্দী

(১৪)রোহিণী


 (১৫)সভীমা

এবং ঐ অধ্যায়ে সন্তানগণনায় পাই,
(১৬)সুদেবা(১৮) কৌশিকী(২০)যৌধিষ্ঠিরী
(১৭)উপাসঙ্গ (১৯)সুতসোমা

এবং সত্যভামার বিবাহকালে কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা,
(২১)ব্রতনী।  
(২২)প্রস্বাপিনী।


আট জনের জায়গায় ২২ জন পাওয়া গেল।

উপন্যাসকারদিগের খুব হাত চলিয়াছিল, এ কথা স্পষ্ট। ইহার মধ্যে ১৩ হইতে ২২ কেবল হরিবংশে আছে। এই জন্য ঐ ১০ জনকে ত্যাগ করা যাইতে পারে। তবু থাকে ১২ জন। গান্ধারী ও হৈমবতীর নাম মহাভারতের মৌসলপর্ব ভিন্ন আর কোথাও পাওয়া যায় না। মৌসলপর্ব যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাহা পরে দেখাইব। এজন্য এই দুই নামও পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। বাকি থাকে ১০ জন।

জাম্ববতীর নাম বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে লেখা আছে,—
“দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিনী।”
হরিবংশে এইরূপ,—
“সুতা জাম্ববতশ্চাপি রোহিণী কামরূপিণী।”

ইহার অর্থে যদি বুঝা যায়, জাম্ববৎসুতাই রোহিণী, তাহা হইলে অর্থ অসঙ্গত হয় না, এবং সেই অর্থই সঙ্গত বোধ হয়। অতএব জাম্ববতী ও রোহিণী একই। বাকি থাকিল ৮ জন।
সত্যভামা ও সত্যাও এক। তাহার প্রমাণ উদ্ধৃত করিতেছি।
সত্রাজিতবধের কথার উত্তরে
“কৃষ্ণঃ সত্যভামামমর্ষতাম্রলোচনঃ প্রাহ, সত্যে, মমৈষাবহাসনা।”
অর্থাৎ কৃষ্ণ ক্রোধারক্ত লোচনে সত্যভামাকে বলিলেন, “সত্যে! ইহা আমারই অবহাসনা।

পুনশ্চ পঞ্চমাংশের ৩০ অধ্যায়ে, পারিজাতহরণে কৃষ্ণ সত্যভামাকে বলিতেছেন,—
“সত্যে! যথা ত্বমিত্যুক্তং ত্বয়া কৃষ্ণাসকৃৎপ্রিয়ম্।”
আবশ্যক হইলে, আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা যথেষ্ট।

অতএব এই দশ জনের মধ্যে, সত্যা সত্যভামারই নাম বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইল। এখন আট জন পাই। যথা—
১।রুক্মিণী
৫।কালিন্দী
২।সত্যভামা
৬।মিত্রবিন্দা
৩।জাম্ববতী
৭।মাদ্রী
৪।শৈব্যা
৮।জালহাসিনী লক্ষ্মণা
ইহার মধ্যে পাঁচ জন—শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, লক্ষ্মণা ও মাদ্রী সুশীলা—ইঁহারা তালিকার মধ্যে আছেন মাত্র। ইঁহাদের কখনও কার্যক্ষেত্রে দেখিতে পাই না। ইঁহাদের কবে বিবাহ হইল, কেন বিবাহ হইল, কেহ কিছু বলে না। কৃষ্ণজীবনে ইঁহাদের কোন সংস্পর্শ নাই। ইঁহাদের পুত্রের তালিকা কৃষ্ণপুত্রের তালিকার মধ্যে বিষ্ণুপুরাণকার লিখিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদিগকে তখনও কর্মক্ষেত্রে দেখি না। ইঁহারা কাহার কন্যা, কোন্ দেশসম্ভূতা, তাহার কোন কথা কোথাও নাই। কেবল, সুশীলা মদ্ররাজকন্যা, ইহাই আছে। কৃষ্ণের সমসাময়িক  মদ্ররাজ, নকুল সহদেবের মাতুল, কুরুক্ষেত্রের বিখ্যাত রথী শল্য। তিনি ও কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে সপ্তদশ দিন, পরস্পরের শত্রুসেনা মধ্যে অবস্থিত। অনেক বার তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে বলিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকে বলিতে হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে শুনিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকেও শুনিতে হইয়াছে। এক পলক জন্য কিছুতেই প্রকাশ নাই যে, কৃষ্ণ শল্যের জামাতা বা ভগিনীপতি, বা তাদৃশ কোন সম্বন্ধবিশিষ্ট। সম্বন্ধের মধ্যে এইটুকু পাই যে, শল্য কর্ণকে বলিয়াছেন, ‘অর্জুন ও বাসুদেবকে এখনই বিনাশ কর’। কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরকে শল্যবধে নিযুক্ত করিয়া তাহার যমস্বরূপ হইলেন। কৃষ্ণ যে মাদ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়াই বোধ হয়। শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা এবং লক্ষ্মণার কুলশীল, দেশ এবং বিবাহবৃত্তান্ত কিছুই কেহ জানে না। তাঁহারাও কাব্যের অলঙ্কার, সে বিষয়ে আমার সংশয় হয় না।
কেন না, কেবল মাদ্রী নয়, জাম্ববতী, রোহিণী ও সত্যভামাকেও ঐরূপ দেখি। জাম্ববতীর সঙ্গে কালিন্দী প্রভৃতির প্রভেদ এই যে, তাঁহার পুত্র শাম্বের নাম, আর পাঁচ জন যাদবের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু শাম্ব  কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ, কেবল এক লক্ষ্মণাহরণে। লক্ষ্মণা দুর্যোধনের কন্যা। মহাভারত যেমন পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত, তেমনি কৌরবদিগেরও জীবনবৃত্ত।লক্ষ্মণাহরণে যদি কিছু সত্য থাকিত, তবে মহাভারতে লক্ষ্মণাহরণ থাকিত। তাহা নাই। লক্ষ্মণাহরণ ভিন্ন যদুবংশধ্বংসেও শাম্বের নায়কতা দেখা যায়। তিনিই পেটে মুসল জড়াইয়া মেয়ে সাজিয়াছিলেন। আমি এই গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে বলিয়াছি যে, এই মৌসলপর্ব প্রক্ষিপ্ত। মুসল-ঘটিত বৃত্তান্তটা অতিপ্রকৃত, এজন্য পরিত্যাজ্য। জাম্ববতীর বিবাহের পরে সুভদ্রার বিবাহ—অনেক পরে। সুভদ্রার পৌত্র পরিক্ষিৎ তখন ৩৬ বৎসরের, তখন যদুবংশধ্বংস। সুতরাং যদুবংশধ্বংসের সময় শাম্ব প্রাচীন। প্রাচীন ব্যক্তির গর্ভিণী সাজিয়া ঋষিদের ঠকাইতে যাওয়া অসম্ভব। জাম্ববতী নিজে ভল্লুককন্যা, ভল্লুকী। ভল্লুকী কৃষ্ণভার্যা বা কোন মানুষের ভার্যা হইতে পারে না। এই জন্য রোহিণীকে কামরূপিণী বলা হইয়াছে। কামরূপিণী কেন না, ভল্লুকী হইয়াও মানবরূপিণী হইতে পারিতেন। কামরূপিণী ভল্লুকীতে আমি বিশ্বাসবান্ নহি, এবং কৃষ্ণ ভল্লুককন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি না।
সত্যভামার পুত্র ছিল শুনি, কিন্তু তাঁহারা কোন কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত নহেন। তাঁহার প্রতি সন্দেহের এই প্রথম কারণ। যবে সত্যভামা নিজে রুক্মিণীর ন্যায় মধ্যে মধ্যে কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত বটে। তাঁহার বিবাহবৃত্তান্তও সবিস্তারে আলোচনা করা গিয়াছে।
মহাভারতের বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ে সত্যভামাকে পাওয়া যায়। ঐ পর্বাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত; মহাভারতের বনপর্বের সমালোচনাকালে পাঠক তাহা দেখিতে পাইবেন। ঐখানে দ্রৌপদীসত্যভামা সংবাদ বলিয়া একটি ক্ষুদ্র পর্বাধ্যায় আছে, তাহাও প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতীয় কথার সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। উহা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিরূপ আচরণ কর্তব্য, তৎসম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধমাত্র। প্রবন্ধটার লক্ষণ আধুনিক।
তার পর উদ্যোগপর্বেও সত্যভামাকে দেখিতে পাই—যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ে। সে স্থানও প্রক্ষিপ্ত, যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ের সমালোচনা কালে দেখাইব। কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বরণ হইয়া উপপ্লব্য নগরে আসিয়াছিলেন—যুদ্ধযাত্রায় সত্যভামাকে সঙ্গে আনিবার সম্ভাবনা ছিল না, এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সত্যভামা সঙ্গে ছিলেন না, তাহা মহাভারত পড়িলেই জানা যায়। যুদ্ধপর্ব সকলে এবং তৎপরবর্তী পর্ব সকলে কোথাও আর সত্যভামার কথা নাই।
কেবল কৃষ্ণের মানবলীলাসম্বরণের পর, মৌসলপর্বে সত্যভামার নাম আছে। কিন্তু মৌসলপর্বও প্রক্ষিপ্ত, তাহাও পরে দেখাইব।
ফলতঃ মহাভারতের যে সকল অংশ নিঃসন্দেহে মৌলিক বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে, তাহার কোথাও সত্যভামার নাম নাই। প্রক্ষিপ্ত অংশ সকলেই আছে। সত্যভামা সম্বন্ধীয় সন্দেহের এই দ্বিতীয় কারণ।
তার পর বিষ্ণুপুরাণ। বিষ্ণুপুরাণে ইঁহার বিবাহবৃত্তান্ত স্যমন্তক মণির উপাখ্যানমধ্যে আছে। যে আষাঢ়ে গল্পে কৃষ্ণের সঙ্গে ভল্লুকসুতার পরিণয়, ইঁহার সঙ্গে পরিণয় সেই আষাঢ়ে গল্পে। তার পর কথিত হইয়াছে যে, এই বিবাহের জন্য দ্বেষবিশিষ্ট হইয়া শতধন্বা সত্যভামার পিতা সত্রাজিতকে মারিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে, জতুগৃহদাহপ্রবাদ জন্য পাণ্ডবদিগের অন্বেষণে গিয়াছিলেন। সেইখানে সত্যভামা তাঁহার নিকট নালিশ করিয়া পাঠাইলেন। কথাটা মিথ্যা। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে যান নাই—গেলে মহাভারতে থাকিত। তাহা নাই। এই সকল কথা সন্দেহের তৃতীয় কারণ।
তার পর, বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামাকে কেবল পারিজাতহরণবৃত্তান্তে পাই। সেটা অনৈসর্গিক অলীক ব্যাপার; প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ঘটনায় তাঁহাকে বিষ্ণুপুরাণে কোথাও পাই না। সন্দেহের এই চতুর্থ কারণ।
মহাভারতে আদিপর্বে সম্ভব-পর্বাধ্যায়ে সপ্তষট্টি অধ্যায়ের নাম ‘অংশাবতরণ’। মহাভারতের নায়কনায়িকাগণ কে কোন্ দেব দেবী অসুর রাক্ষসের অংশে জন্মিয়াছিল, তাহাই ইহাতে লিখিত হইয়াছে। শেষ ভাগে লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের অংশ, বলরাম শেষ নাগের অংশ প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারের অংশ, দ্রৌপদী শচীর অংশ, কুন্তী ও মাদ্রী সিদ্ধি ও ধৃতির অংশ। কৃষ্ণমহিষীগণ সম্বন্ধে লেখা আছে যে, কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী অপ্সরাগণের অংশ এবং রুক্মিণী লক্ষ্মী দেবীর অংশ। আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর নাম নাই। সন্দেহের এই পঞ্চম কারণ। সন্দেহের এ কারণ কেবল সত্যভামা সম্বন্ধে নহে। রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের সকল প্রধানা মহিষীদিগের প্রতি বর্তে। নরকের ষোড়শ সহস্র কন্যার অনৈসর্গিক কথাটা ছাড়িয়া দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের আর কোনও মহিষী ছিল না, ইহাই মহাভারতের এই অংশের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
ভল্লুকদৌহিত্র শাম্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা বাদ দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণীবংশেই রাজা হইল—আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না।
এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না।  ইহা নিশ্চিত বটে যে, সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ন যে, সে কোন মতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তপরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না, তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। আদালতে যে গৌরববৃদ্ধি হয়, তাহার উদাহরণ আমরা সভ্যতর সমাজে দেখিতে পাইতেছি। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তা বুঝিতে পারি না। ইউরোপ যিহুদার নিকট শিখিয়াছিল যে, কোন অবস্থাতেই দারান্তর গ্রহণ করিতে নাই। যদি ইউরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেন্‌রীকে কথায় কথায় পত্নীহত্যা করিতে হইত না। ইউরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, যাহাই বিলাতী, তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।
কৃষ্ণ একাধিক বিবাহ করিয়াছিলেন কি না, সে বিষয়ে কোন গণনীয় প্রমাণ নাই, ইহা দেখিয়াছি। যদি করিয়া থাকেন, তবে কেন করিয়াছিলেন, তাহারও কোন বিশ্বাসযোগ্য ইতিবৃত্ত নাই। যে যে তাঁহাকে স্যমন্তক মণি উপহার দিল, সে সঙ্গে সঙ্গে অমনি একটি কন্যা উপহার দিল, ইহা পিতামহীর উপকথা। আর নরকরাজার ষোল হাজার মেয়ে, ইহা প্রপিতামহীর উপকথা। আমরা শুনিয়া খুশি—বিশ্বাস করিতে পারি না।

Thursday, July 2, 2020

বেদে মাংসাহার

বেদে মাংস আহার

বৈজ্ঞানিক ভাষ্য থেকে দেখবো বেদে মাংস আহার নিয়ে কিছু বলা আছে কিনা।
এতদ্বা উ স্বাদীয়ো ঢদধিগবং ক্ষীরং বা।
                   মাংসং বা তদেব নাশ্নীয়াত্।।৯।।  (অথর্ব০ ৯/৬/৯
এই মন্ত্রে আচার্য সায়ণ ভাষ্য করেনি।
পণ্ডিত শ্রীপাদ দামোদর সাতবলেকর ভাষ্য
পদার্থঃ (এতত্ বৈ উ স্বাদীয়ঃ) সে যে স্বাদযুক্ত আছে (য়ত্ অধিগবং ক্ষীরং বা মাংসং বা) যে গাভী থেকে প্রাপ্তকারী দুধ অথবা অন্য মাংসাদি পদার্থ আছে (তত্ এব ন আশ্নীয়াত্) তাহার মধ্যে থেকে কোন পদার্থ অতিথির পূর্বেও খাবে না।।৯।।

এই মন্ত্রের উপর আচার্য অগ্নিব্রত ন্যাষ্টিক জীর মত
ইনাদের ভাষ্যতে আর্ বিদ্বান প্রো০ বিশ্বনাথ বিদ্যালংকারই এই মাংসের অর্থ পনীর করেছেন, তবে পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদীই মনন সাধক (বুদ্ধিবর্ক) পদার্থকে মাংস বলেছেন। সবাই এই মন্ত্র তথা সূক্তের অন্য মন্ত্রের বিষয় অতিথি সৎকার বলেছেন। এই মন্ত্রের দেবতা পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদীর দৃষ্টিতে অতিথি বা অতিথিপতি, যখন পণ্ডিত সাতবলেকরই অতিথি বিদ্যা মেনেছেন। পণ্ডিত সাতবলেকরই ইহার ঋষি ব্রহ্মা মেনেছেন। ছন্দ পিপীলিকা মধ্যা গায়ত্রী। {ব্রহ্মা=মনো বৈ য়জ্ঞস্য ব্রহ্মা (শ০ ১৪/৬/১/৭); প্রজাপতিবৈ ব্রহ্মা (গো০ উ০ ৫/৮)। অতিথিঃ=য়ো বৈ ভবতি য়ঃ শ্রেষ্ঠতামশ্নুতে স বা অতিথির্ভবতি (ঐ০ আ০ ১/১/১)। অতিথিঃ= অতিথিপতির্বাবাতিথেরীশে (ক০ ৪৬/৪-ব্রা০ উ০ কো০ থেকে উদ্ধৃত)। পিপীলিকা=পিপীলিকা পেলতের্তিকর্ণঃ (দৈ০ ৩.৯)। স্বাদু=প্রজা স্বাদু (ঐ০আ০ ১.৩.৪); প্রজা বৈ স্বাদুঃ (জৈ০ ব্রা০ ২/১৪৪); মিথুনং বৈ স্বাদু (ঐ০ আ০ ১/৩/৪)। ক্ষীরম্=য়দত্যক্ষরত্ তত্ ক্ষীরস্য ক্ষীরত্বম্ (জৈ০ ব্রা০ ২/২২৮)। মাংসম্=মাংসং বৈ পুরীষম্ (শ০ ৮/৬/২/১৪); মাংসং বা মানসং বা মনোহস্মিন্ সীদতীতি বা (নি০ ৪/৩); মাংসং সাদনম্ (শ০৮/১/৪/৫)}

অগ্নিব্রত ন্যাষ্টিক জীর আধিদৈবিক ভাষ্য
পদার্থঃ (এতত্ বা স্বাদীয়ঃ) যে অতিথি অর্থাৎ সতত গমনশীলা প্রাণ, ব্যান রশ্মির এবং অতিথিপতি অর্থাৎ প্রাণোপান রশ্মির নিয়ন্ত্রক সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির স্বাদুযুক্ত হয়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মিকে মিথুন বানিয়ে নানা পদার্থের উৎপন্ন করাতে সহায়ক হয়। (য়ত্) যে প্রাণব্যান বা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির (অধিগবং ক্ষীরং বা মাংসং বা) গমনকারী অর্থাৎ ‘ও৩ম্’ ছন্দ রশ্মি রূপী সূক্ষ্মতম বাক্ তত্বে আশ্রিত হয়, সাথেই নিজের পুরীষ=পূর্ণ সংযোজন বল {পুরীষম্=পূর্ণং বলম্ (ম০ দ০ য়০ ভা০ ১২/৪৬); ঐন্দ্রং হি পুরীষম্ (শ০ ৮/৭/৩.৭); অন্নং পুরীষম্ (শ০ ৮/১/৪/৫)} এর সাথে নিরন্তর নানা রশ্মি বা পরমাণু আদি পদার্থের উপর ঝড়তে থাকে। এই ‘ও৩ম্’ রশ্মির ঝড়নাই ক্ষীরত্ব তথা পূর্ণ সংযোতাই মাংসত্ব বলা হয়। এখানে ‘মাংস’ শব্দ এই সংকেত দেয়, যে এই ‘ও৩ম্’ রশ্মির মনস্তত্ব এখানে সর্বাধিক মাত্রাতে বসে থাকেন। এই ‘ও৩ম্’ রশ্মির প্রাণব্যান এবং সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির উপর ঝড়ে অন্য স্থুল পদার্থের উপর পড়তে থাকে। (তত্ এব ন অশ্নুয়াত্) এই কারণ দ্বারা বিভিন্ন রশ্মি বা পরমাণু আদি পদার্থের মিথুন বানানোর প্রক্রিয়া নষ্ট হয় না। ইহা প্রক্রিয়া অতিথিরূপ প্রাণব্যানকে মিথুন বানানো  কিংবা ইহার দ্বারা বিভিন্ন মরুদাদি রশ্মির আকৃষ্ট করার প্রক্রিয়া শান্ত হওয়াতে পূর্বে নষ্ট হয় না, বরং তাহার পশ্চাৎ অর্থাৎ  দুই কণের সংযুক্ত হওয়ার পশ্চাৎ আর মিথুন বানানোর প্রক্রিয়া নষ্ট বা  বন্ধ হয়ে যায়, ইহা জানা উচিত।।৯।।

এই ঋচার সৃষ্টির উপর প্রভাব
আর্ষ বা দৈবত প্রভাব-ইহার ঋষি ব্রহ্মা হওয়াতে সংকেত পাওয়া যায় যে ইহার উৎপত্তি মন এবং ‘ও৩ম্’ রশ্মির মিথুন দ্বারাই হয়। এই মিথুন এই ছন্দ রশ্মির নিরন্তর বা নিকটতা থেকে প্রেরিত করতে থাকে। ইহাকে দৈবত প্রভাব দ্বারা প্রাণ, ব্যান তথা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির বিশেষ সক্রিয় হয়ে নানা সংযোগ কর্মের সমৃদ্ধ করেন।

ছান্দস প্রভাব-ইহার ছন্দ পিপীলিকা মধ্যা গায়ত্রী হওয়াতে এই ছন্দ রশ্মি বিভিন্ন পদার্থের সংযোগের সময় তাহার মধ্যে তীব্র তেজ বা বলের সাথে সতত সঞ্চারিত হয়। ইহা থেকে ঐ পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন পদার্থ তেজ এবং বলের প্রাপ্ত হতে থাকে।

ঋচার প্রভাব-যখন কণার সংযোগ হয়, তখন তাহার মধ্যে প্রাণ, ব্যান বা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির বিশেষ যোগদান হতে থাকে। এই রশ্মির বিভিন্ন মরুদ্ রশ্মির দ্বারা আকুঞ্চিত আকাশ তত্বকে ব্যাপ্ত করে নেয়। ইহা সময় এই রশ্মির উপর সূক্ষ্ম ‘ও৩ম্’ রশ্মির নিজের সেচন করে ইহাতে অধিক বল দ্বার যুক্ত করেন। ইহা থেকে উভয় কণার মধ্যে ফীল্ড নিরন্তর প্রভাবী হয়ে ঐ উভয়  কনার পরস্পর সংযুক্ত করে দেয়।

আচার্য অগ্নিব্রত ন্যাষ্টিকের আধিভৌতিক ভাষ্য
পদার্থঃ (এতত্ বা স্বাদীয়ঃ) এই যে স্বাদিষ্ট ভোজ্য পদার্থ আছে। (য়দধিগবং ক্ষীরং বা) যে গাভী দ্বারা প্রাপ্তকারী দুধ, ঘৃত, মাখন, দই আদি পদার্থ আছে অথবা (মাংসম্ বা) মনন, চিন্তন আদি কার্যে উপযোগী ফল, শুকনো ফল আদি পদার্থ। (তদেব ন অশ্নীয়াত্) ঐ পদার্থকে অতিথির খাওয়ানোর  পূর্বে খাবে না অর্থাৎ অতিথির খাওয়ানোর পশ্চাৎই খাওয়া উচিত। যাহারা অতিথি থেকে পূর্বে না খাওয়ার প্রসংগত ইহার পূর্ব মন্ত্র থেকে সিদ্ধ হয়, যেখানে লেখা আছে-“অশিতাবত্যতিথাবশ্নীয়াত্”=
অশিতাবতি অতিথৌ অশ্নীয়াত্। এই প্রকরণের পূর্ব আধিদৈবিক ভাষ্যেও উপলব্দি।
....................................................................................
{‘মাংসম্’ পদের বিবেচনাঃ- এই বিসয়ে সর্বপ্রথম আর্য বিদ্বান পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মা কৃত “বৈদিক সম্পত্তি” নামক গ্রন্থতে আয়ুর্বেদের কিছু গ্রন্থের উদ্ধৃত করে বলেন-

“সুশ্রুতে আমের ফলের বর্ণন করে লিখেছেন-
অপক্বে চূতফলে স্নায়্যস্থিমজ্জানঃ সূক্ষ্মত্বান্নোপলভ্যন্তে পক্বে ত্বাহবির্ভূতা উপলভ্যন্তে।
অর্থাৎ আমের কাচা ফলের আসে, হাড্ডির আর মজ্জা আদি প্রতীত হয় না, কিন্তু পাকার পরে সব আবির্ভূত হয়ে যায়।

এখানে আটির তন্তু সর্বাঙ্গে, আটি হাড্ডির, আশে আর চিকন ভাগ মজ্জা বলা হয়েছে। এই প্রকারে বর্ণন ভাব প্রকাশেও এসেছে। সেখানে লেখা আছে যে- 
आम्रास्यानुफले भवन्ति युगपन्मांसास्थिमज्जादयो लक्ष्यन्ते न पृथक् पृथक् तनुतया पुष्टास्त एव स्फुटाः। एवं गर्भसमु˜वे त्ववयवाः सर्वे भवन्त्येकदा लक्ष्याः सूक्ष्मतया न ते प्र्रकटतामायान्ति वृद्धिग्ताः।
অর্থাৎ যে প্রকার কাচা আমের ফলে মাংস, অস্থি আর মজ্জাদি পৃথক-পৃথক দেখা যায় না, কিন্তু পাকার পরেই জ্ঞাত হয় ওই প্রকার গর্ভের আরম্ভে মনুষ্যের অঙ্গ জ্ঞাতহয় না, কিন্তু যখন তাহার বৃদ্ধি হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে যায়।

এই দুই প্রমাণের দ্বারা প্রকট হয়ে থাকে যে ফলের মধ্যেও মাংস, অস্তি, নাড়ী আর মজ্জা আদি ইহা প্রকার বলা হয়েছে, যে প্রকার প্রাণির শরীরে। বৈদ্যকের এক গ্রন্থে লিখেছে যে-
प्रस्थं कुमारिकामांसम्।
এক বাঘ কুমারিকার মাংস। যেখানে ঘৃতকুমারীর কুমারিকার আর তাহার মলদ্বারের মাংস বলা হয়েছে।

বরার তাৎপর্য এই যে যে প্রকার ঔষধির আর পশুদের নাম একই শব্দ দ্বারা রাখা হয়েছে ওই প্রকার ঔষধির আর পশুদের শরীরাবয়বও একই শব্দ দ্বারা বলা হয়েছে। এই প্রকারের বর্ন আয়ুর্বেদের গ্রন্থেও ভরা আছে।
শ্রীবেনকটেশ্বর প্রেস, বুম্বাইতে ছাপানো ‘ঔষধিকোষ’ এ নীচে লেখা সমস্ত পশুসংজ্ঞক নাম আর অবয়ব বনস্পতির জন্যও এসেছে দেখে নিন। আমরা নমুনার জন্য কিছু শবোদর উদ্ধৃত করেছি-
বৃষভ-ঋষভকন্দ
সিংহী-কটেলী, বাসা
হস্তি-হস্তিকন্দ
শ্বান-কৃত্তাঘাস, গ্রন্থিপর্ণ
খর-খরপর্ণিনী
বপা-ঝিল্লী=বক্কল ওষুধ ব্যবহারের জালা
মার্জার-বল্লীঘাস, চিত্ত
কাক-কাকমাচী অস্থি-গুঠলী
ময়ুর-ময়ুরশিখা
বারাহ-বারাহীকন্দ
মাংস-গুদা, জটাংমাসী
বীছূ-বীছূবূটী
মহিষ-মহিষাক্ষ, গুগ্গুল
চর্ম-বক্কল
সর্প-মর্পিণীবূটী
শ্যেন-শ্যেনঘন্টী (দন্তী)
স্নায়ু-রেশা
অশ্ব-অশ্বগন্ধা, অজমোদা
মেষ-জীবনাশক
নখ-নখবূটী
নকুল-নাকুলীবূটী
কুক্কুট (টী) শালামলীবৃক্ষ
মেদ-মেদা
হংস-হংসপদী
নর-সৌগন্থিক তৃণ
লোম (শা)-জটামাসী
মৎস্য-ঘমরা
হৃদ-দারচীনী
মূষক-মূষাকর্ণী
মৃগ-সহদেবী, ইন্দ্রায়ণ, জটামসী, কপুর
পেশী-জটামসী
গো-গৌলোমী পশু-অম্বাড়া, মোথা
রুধির-কেসর
মহাজ-বড়ী অজবায়ন
কুমারী-ঘীকুমার
আলম্ভন-স্পর্শ
এই সূচীতে সমস্ত পশু পক্ষীর আর তাহার অঙ্গের নাম তথা সমস্ত বনস্পতির আর তাহার অঙ্গের নাম একই শব্দ দ্বারা সূচিত করেছেন। এরূপ দমাতে কিছু শব্দ দ্বারা পশু আর তাহার অঙ্গই গ্রহণ করা উচিত নয়।

বিজ্ঞ পাঠক যেখানে বিচারের ঐরূপ স্থিতিতে যেখানে ‘মাংসম্’ পদ দ্বারা গৌ আদি পশুর বা পক্ষির মাংস গ্রহণ করা কি মুর্খতা নয়? যেখানে কোন পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারা অভিভূত তথা বৈদিক বা ভারতীয় সংস্কৃতি বা ইতিহাসের উপহাসকর্তা কথিত প্রবুদ্ধ কিংবা মাংসাহারের পোষক সংস্কৃত ভাষার ঐরূপ নামের উপর ব্যঙ্গ্য না করেন, এই কারণে আমরা তাহাদের ইংরেজি ভাষারও কিছু উদাহরণ দিয়েছি-

1. Lady Finger ভেণ্ডী বলা হয়। যদি ভোজন বিষয়ে কেউ ইহার অর্থ কোন মহিলার আঙ্গুল করে, তখন কি তাহার অপরাধ হবে না:
2. Vegetable কোন শাক বা বনস্পতিকে বলা হয়। এদিকে Chamber dictonary মধ্যে ইহার অর্থ dull understanding person ও দেওয়া আছে। যদি Vegetable খেতে বসে কোন ব্যক্তির দেখে কেউ তাহাকে মন্দবুদ্ধি মনুষ্যকে খাদ্য পদার্থ বলে, তখন কি ইহা মূর্খতা হবে না?
3. আয়ুর্বেদে এক চারা গাছ আছে, গোবিষ, যাহাকে হিন্দীতে কাকমারী তথা ইংরেজিতে Fish berry বলা হয়। যদি কেউ ইহার অর্থ মাছের রস লাগায়, তখন তাহাকে কি বলা হয়?
4. potato আলু বলা হয়, এদিকে ইহার অর্থ A mentally handicaped person ও হয়, তখন কি আলু খাওয়াকে মানসিক রোগী মনুষ্যকে ভক্ষণকারী মানা হয়?
5. Hag ইহা এক প্রকারের ফল আছে, এদিকে An ugly old woman এরও hag বলা হয়, তখন কি এটাও কোন hag ফলের অর্থ উল্টো লাগানোর প্রয়াস করবেন?

এখন আমরা ইহার উপর বিচার করছি যে ফলের মলদ্বারের মাংস কি বলা হয়? যেখানে আচার্য অগ্নিব্রত ন্যাষ্টিকের আধিদৈবিক ভাষ্যে লিখে এসছি যে পূর্ণবলযুক্ত বা পূর্ণবলপ্রদ পদার্থকে মাংস বলা হয়। সংসারে সব মনুষ্য ফলের মলদ্বারকেই প্রয়োগ করেন, অন্য ভাগকে নয়, কেননা ফলের সার ভাগ সেই হয়। সেই ভাগ বল-বীর্যের ভাণ্ডার অর্থাৎ তাহার ভক্ষণ দ্বারা বল-বীর্য-বুদ্ধি আদির বুদ্ধি হয়। এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে প্রাণিদের শরীরের মাংসকে মাংস বলে? ইহার উত্তর এই যে কোন প্রাণির শরীরের বল তাহার মাংসপেশীর অন্তর্গতই নিহিত থাকে, ইহার কারণে ইহাও মাংস বলা হয়। যেরূপ শাকাহারী প্রাণী ফলের মলদ্বারকেই বিশেষ ভক্ষণ করেন, ঐরূই সিংহাদি মাংসাহারী প্রাণী, প্রাণীর মাংস ভাগকেই বিশেষ রূপে খেয়ে থাকে। এই উভয়ের মধ্যে সমানতা আছে। যে স্থান ফলের মধ্যে মলদ্বারের হয়, সেই স্থান প্রাণিদের শরীরে মাংস হয়। মনুষ্য প্রাকৃতিক রূপে কেবল শাকাহারী বা দুগ্ধাহারী প্রাণী আছে, এই কারণে বেদাদি শাস্ত্রে প্রাণিদের মাংস খাওয়ার চর্চা বেদাদি শাস্ত্রের পরম্পরা দ্বারা সর্বদা অনভিজ্ঞতার পরিচায়ক। এরূপ চর্চাকারী কথিত বেদজ্ঞ, চাই বিদেশী হোক বা স্বদেশী, আমাদের দৃষ্টিতে তাহারা বেদাদি শাস্ত্রের বর্মালাও জানে না, যথার্থ তহারা ব্যকরণাদি শাস্ত্রের কেমনই বড় অধ্যেতা-অধ্যাপক কি নয়। মাংসাহারের বিষয়ে আমরা পৃথকে এক গ্রন্থ লিখার পরে আবার কখনো বিচার করেন, যাহার মধ্যে বিশ্বভরে মাংসাহারীর সব শংকার সমাধান হবে।

প্রশ্ন-বেদে ‘মাংসম’ পদের অর্থ প্রাণিদের মাংস কদাপি হয় না, ইহা আপনার পূর্বাগ্রহ কি মানা যায় না, যে কেবল শাকাহারের আগ্রবশেই করেছেন?

উত্তর-যে পরম্পরাতে সামান্য যোগসাধকের জন্য অহিংসার প্রথম সোপান বলা হয়, যেকানে মন, বচন,কর্ম দ্বারা বলেছেন বা কখনো সব প্রাণির প্রতি বৈরী ত্যাগ অর্তাৎ প্রীতির সন্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, সেখানে সিদ্ধ পুরুষ যোগিদের এবং ওই ক্রমে নিজের যোগসাধনা দ্বারা ঈশ্বর বা মন্ত্রের সাক্ষাৎকৃতধর্মা মহর্ষিরা, তাহার গ্রন্থে এবং বেদরূপ ঈশ্বরীয় গ্রন্থের দ্বারা হিংসার সন্দেশ দেওয়া মূর্খতা বা দুষ্টতা নয়, তো কি? যে বিদ্বান বৈদিক অহিংসার স্বরূপ দেখতে চায়, তিনি পতঞ্জল যোগদর্শনের ব্যাসভাষ্যে স্বয়ং পড়ে দেখুন। ইহা ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যাহা প্রায়ঃ সব ভাষ্যকারই পশুর নৃশংস বধ এবং তাহার অঙ্গকে ভক্ষণের বিধান করেছেন, সেখানে আমরা তাহার কেমন গূঢ় বিজ্ঞান প্রকাশিত করেছি, ইহা পাঠক এই বেদ-বিজ্ঞান আলোক গ্রন্থের সম্পূর্ণ অধ্যয়ন দ্বারা জানা যাবে। পাঠকের জানার জন্য আমরা বেদের কিছু প্রমাণ দিচ্ছি-

য়দি নো গাং হংসি য়দ্যশ্চং য়দি পূরুষম।
তং ত্বা সীসেন বিধ্যামঃ।। অথর্ব০ ১/১৬/৪
অর্থাৎ তুমি যদি আমাদের গাভী, ঘোড়া বা মনুষ্যকে হত্যা করো, তবে আমরা তোমাকে সীসা দিয়ে ছেদ করে দেবো।

মা নো হিংসিষ্ট দ্বিপদো মা চতুষ্পদঃ।। (অথর্বঃ ১১/২/১)
অর্থাৎ আমাদের মনুষ্য আর পশুদের নষ্ট করো না। অন্যত্র বেদে দেখেনে-
ইমং মা হিংসীদ্রবিপাদ পশুম্।(যজুঃ ১৩/৪৭)
অর্থাৎ এই দুই খুরবান পশুকে হিংসা করো না।
ইমং মা হিংসীরেকশফং পশুম্।(যজুঃ ১৩/৪৮)
অর্থাৎ এই এক খুরবান পশুদের হিংসা করো না।
য়জমানস্য পশুন্ পাহি।(যজুঃ ১/১)
অর্থাৎ যজমানের পশুদের রক্ষা করো।
আপনারা বলতে পারেন যে এই কথা যজমান বা কোন মনুষ্য বিশেষের পালিত পশুরই বলেছে নাকি সমস্ত প্রাণির? এই ভ্রমের নিবারণার্থ অন্য প্রমাণ-
মিত্রস্যাহং চক্ষুসা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষে।(যজুঃ ৩৬/১৮)
অর্থাৎ আমি সব প্রাণিদের মিত্রের দৃষ্টিতে দেখব।
মা হিংসীস্তন্বা প্রজাঃ।(যজুঃ ১২/৩২)
অর্থাৎ এই শরীর দ্বারা প্রাণিদের মের না।
মা স্রেধত।(ঋ০৭/৩২/৯) অর্থাৎ হিংসা করো না।

মহর্ষি জৈমিনীর পশ্চাৎ সব থেকে মহান বেদবেত্তা মহর্ষি দয়ানন্দের মাংসাহারের বিষয়ে বিচারও পাঠক পড়ুন-
“মদ্যমাংসাহাররী অনার্য জাতির যাহার শরীর মদ্যমাংসে পরমাণুর দ্বারাই পরিপূর্ণ আছে, তাহার হাতে খাবে না।”
“এই পশুদের হত্যাকারীর সব মানুষ্যের হত্যাকারী জানবে।”
“যখন থেকে বিদেশী মাংসাহারী এই দেশে এসে গরু আদি পশুদের হত্যাকারী মদ্যপায়ী রাজ্যাধিকারী হয়ে, তখন থেকে ক্রমশঃ আর্যের দুঃখের সীমা বাড়তে থাকে।”-সত্যার্থ প্রকাশ; দশম সমুল্লাস

দেখুন দয়ার সাগর ঋষি দয়ানন্দ কি বলছেন-
“পশুদের গরা ছুরি দিয়ে কেটে নিজের পেট ভরেন, সব সংসারের হানি করেন। কি সংসারে তাহাদের থেকেঅধিক কোন বিশ্বাসঘাতক, অনুপকারী, দুঃখ দানকারী পাপীজন হয়”?
“হে মাংসহারিরা! তোমরা রোক যখন কোন সময়ের পশ্চাৎ পশু না পাওয়া যাবে তখন মনুষ্যের মাংসও ছাড়বে না”?
“হে ধার্মিক লোক! আপনারা এই পশুদের রক্সা তন, মন আর ধন দ্বারা কি করেন না”? (গোকরুণানিধি)
আশা হয় বুদ্ধিমান এবং নিষ্পক্ষ পাঠকের মাংসাহারের ভ্রান্তি নির্মুল হয়ে গিয়েছে।
....................................................................................
আচার্য অগ্নিব্রত ন্যাষ্টিক এর আধ্যাত্মিক ভাষ্য
{মাংসম্=মন্যতে জ্ঞয়তেহনেন তত্ মাংসম্ (উ০ কো০ ৩/৬৪); মাংসং পুরীষম্ (শ০ ৮/৭/৪/১৯); (পুরীষম্=পুরীষং পুণাতেঃ পূরয়তের্বা-নিরু০ ২/২২); সর্বত্রাহভিব্যাপ্তম্-ম০ দ০ য়০ ভা০ ৩৮/২১; য়ত্ পুরীষং স ইন্দ্রঃ-শ০১০/৪/১/৭; স এষ প্রাণ এব য়ত্ পুরীষম্-শ০৮/৭/৩/৬)}

পদার্থঃ (এতত্ বা উ স্বাদীয়ঃ) যোগী পুরুষের সমক্ষ পরমানন্দের আস্বাদনকারী এই পদার্ বিদ্যমান থাকে, যাহার কারণ জীবের পরমাত্মার সাথে সহযোগে থাকে, (য়দধিগবং ক্ষীরং বা মাংসং বা) তাহার পদার্থ যোগীর মন আদি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে। তাহার পদার্থ কি হয়, ইহার উত্তর এই হয় যে সর্বত্র অভিব্যাপ্ত পরমৈশ্বর্ সম্পন্ন ইন্দ্ররূপ পরমাত্মা থেকে ঝড়তে থাকে ‘ও৩ম্’ বা গায়ত্রী আদি বেদের ঋচাই তাহার পদার্থ, যে যোগীর ইন্দ্রিয় বা অন্তঃকরণে নিরন্তর স্রবিত হতে থাকে। যোগী ঐ আনন্দময়ী ঋচার রসাস্বাদন করতে থাকে, তখন সে পরমাত্মার অনুভব করতে থাকে। (তদেব ন অশ্নীয়াত্) যোগী ঐ ঋচার আনন্দকে ওই সময় পর্যন্ত অনুভব করতে পারে না, যখন পর্যন্ত যে তিথিরূপ প্রাণ তত্ব, যে যোগীর মস্তিক্য বা শরীরে সতত সঞ্চরিত হয়, ওই ঋচার সাথে সংগত হয় না। যেখানে অতিথি দ্বারা পূর্বের প্রকরণ পূর্ববৎ অভিপ্রায়।।৯।।

ভাবার্থঃ যখন কোন যোগী যোগসাধনা করেন আর এই অর্থে প্রণব বা গায়ত্রী আদির যথাবিধ জপ করেন, তখন সর্বত্র অভিব্যাপ্ত পরমৈশ্বর্যবান ইন্দ্ররূপ ঈশ্বর থেকে নিরন্তর প্রবাহিত ‘ও৩ম্’ রশ্মি ওই যোগীর অন্তঃকরণ তথা প্রাণের অন্তর স্রবিত হতে থাকে। ইহা থেকে সে যোগী ওই রশ্মির রসাস্বাদন করে আনন্দে নিমগ্ন হয়ে যায়।।৯।।

বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ দ্বারা উদ্ধৃত
(পূর্বপীঠিকা-বেদের যথার্থ স্বরূপ, নবমোধ্যায়)

।।ও৩ম্ শান্তি শান্তি শান্তি।।

Wednesday, July 1, 2020

মাতৃশক্তি ও বেদ

 নারী তার পছন্দ মতো জীবন সঙ্গী বেছে নেবে-
ব্রহ্মচর্য়েণ কন্যা৩ য়ুবানং বিন্দতে পতিম্।
অনড্বান্ব্রহ্মচর্য়েনাশ্বো ঘাসং জিগীর্তি।।১৮।। (অথর্ব০ ১১/৫/১৮)
পদার্থঃ (ব্রহ্মচর্য়েণ) ব্রহ্মচর্য [বেদাধ্যয়ন আর ইন্দ্রিয়নিগ্রহ] দ্বারা (কন্যা) কন্যা [পছন্দের যোগ্য ছেলে] 
(য়ুবানম্) যুবা [ব্রহ্মচর্য দ্বারা বলবান] (পতিম্) স্বামী [পালনকর্তা বা ঐশ্বর্বান পতি] কে (বন্দতে) প্রাপ্ত করেন। (অনড্বান্) [রথ নিয়ে চালনাকারী] দামড়া-ছিন্নমুষ্ক ষাঁড় আর (অশ্বঃ) ঘোড়া (ব্রহ্মচর্য়েণ) ব্রহ্মচর্যের সাথে [নিয়ম দ্বারা নৈষ্টিক ব্রহ্মচারী হয়ে] (ঘাসম্=ঘাসেন) ঘাস দ্বারা (জিগীর্ষতি) সিঞ্চন করে [গর্ভাধান করে] ইচ্ছা করে।।১৮।।
ভাবার্থঃ কন্যা ব্রহ্মচর্য দ্বারা পূর্ণ বিদুষী আর যুবতী হয়ে পূর্ণ ব্রহ্মচারী বিদ্বান যুবা পুরুষের সাথে বিবাহ করবে আর যেরূপ দামড়া -ছিন্নমুষ্ক ষাঁড়, ঘোড়া আদি বলবান আর শীঘ্রগামী পশু ঘাস তৃণ ভক্ষণ করে ব্রহ্মচর্য নিয়ম দ্বারা সময়ে বলবান সন্তান উৎপন্ন করে, ঐরূপই মনুষ্য পূর্ণ ব্রহ্মচারী, বিদ্বান যুবা হয়ে নিজের সদৃশ্য কন্যার বিবাহ করে নিয়ম পূর্বক বলবান, সুশীল সন্তান উৎপন্ন করবে।।১৮।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরনদাস ত্রিবেদী

নারী নিজের জ্ঞানের দ্বারা সংসারকে সমৃদ্ধি করেন-
কুহূর্দেবানামমৃতস্য পত্নী হব্যা নো অস্য হবিষো জুষেত।
শৃণোতু য়জ্ঞমুশতী নো অদ্য রায়স্পোষং চিকিতুষী দধাতু।।২।। (অথর্ব০ ৭/৪৭/২)
পদার্থঃ (দেবানাম্) দেবের মধ্যে (অমৃততস্য) অমৃত ব্যক্তির (পত্নী কুহূঃ) পত্নী কুহূ, [বিচিত্র স্বভাবের স্ত্রী] (হব্যা) সৎকার পূর্বক আহ্বানীয়, (অদ্য) এই সময় (নঃ অস্য হবিষঃ) আমাদের এই হবিষ্যান্নর (জুষেত) সেবন করে, ভোজন করে। (শৃণোতু) আমাদের প্রার্থনা শুনে, (য়জ্ঞমুশতী) গৃহস্থযজ্ঞের কামনাকারী, (চিকিতুষী) তথা সম্যক-জ্ঞানবান বিদুষী, (নঃ) আমাদের (রায়স্পোষম্) নিজ জ্ঞানরূপী সম্পত্তি (দধাতু) প্রদান করে।।২।।
নারী যেন দুঃখ্য কষ্ট না পায়-
ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাঞ্জনেন সর্পিষা সংস্পৃশন্তাম্।
অনশ্রবো অনমীবাঃ সুরত্না আ রোহন্তু জনয়ো য়োনিমগ্রে।।৩১।। (অথর্ব০ ১২/২/৩১)
পদার্থঃ (অবিধবাঃ) না বিধবা অর্থাৎ জীবিত পতিশীল, (সুপত্নীঃ) উত্তম-পত্নিরা-(ইমাঃ নারীঃ) অর্থাৎ যে নারীরা (আঞ্জনেন-অঞ্জনেন) অঞ্জন, (সর্পিষা) আর দ্রব্যভূত ঘৃতের সাথে (সংস্পৃশন্তাম্) সংস্পর্শ করেন। (অনশ্রবঃ) অশ্রু থেকে রহিত অর্থাৎ সদা সুপ্রসন্ন, (অনমীবাঃ) রোগ রহিত, (সুরত্নাঃ) অলংকারের দ্বারা সুভূষিত, (জনয়ঃ)  সন্তানোৎপাদিকা এই নারীরা, (য়োনিম্) ঘরে (অগ্রে) পতিকে আগে-আগে হয়ে (আরোহন্তু) চড়ে, প্রবেশ করেন।।৩১।।
[আরোহন্তু=ঘরের ভিত পৃথিবীতল দ্বারা উচু আর সীড়িযুক্ত হওয়া উচিত। (য়োনিঃ গৃহনাম=নিঘ০ ৩/৪)। সংস্পৃশন্তাম্=অঞ্জন দ্বারা চোখের তথা সর্পিঃ দ্বারা শরীরে স্পর্শ]।
ভাষ্যঃ প্রো০ বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার

নারী বিদ্যার দ্বারা শোভা বাড়াবে-
রেভ্যাসীদনুদেয়ী নারার্সী ন্যোচনী।
সূর্য়ায়া ভদ্রমিদ্বাসো গাথয়ৈতি পরিষ্কৃতা।।৭।। (অথর্ব০ ১৪/১/৭)
পদার্থঃ (রৈভী) বেদবাণী (সূর্য়ায়াঃ) প্রেরণাকারী [বা সূর্যের উজ্জ্বলতার সমান তেজশালী] কন্যার (অনুদেয়ী) সহচর [তুল্য] আর (নারাশংসী) মনুষ্যের গুণের স্তুতি (ন্যোচনী) খাঁটি [ছোট সহজ-সরল তুল্য] (আসীত্) হয়। আর (ভদ্রম্) শুভ কর্ম (ইত্) ই (বাসঃ) বস্ত্র [সমান] হোক [কেননা সে] (গাথয়া) গাওয়ার যোগ্য বেদ বিদ্যা দ্বারা (পরিষ্কৃত) সজ্জিত হয়ে (এতি) চলতে থাকে।।৭।।
ভাবার্থঃ কন্যা বেদ আর ইতিহাসকে স্বাধ্যায় করে বিচার পূর্বক শুভ কর্মকরে উত্তম বিদ্যা দ্বারা নিজের শোভা বাড়াবে।।৭।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরনদাস ত্রিবেদী

।।ও৩ম্ শম্।।

Thursday, June 25, 2020

জাকির নায়েকের যুক্তি অনুযায়ী মুহম্মদ কল্কি অবতার

জাকির নায়েক নবীকে হিন্দুদের অবতার বানানোর চেষ্টা করলেন
মানে তিনি হিন্দুদের অবতারবাদে বিশ্বাস করলেন, মানে তিনি কূর্ম অবতার, বুদ্ধ অবতার, বরাহ অবতার প্রভৃতিকে মেনে নিলেন, কারণ এগুলো অবতারের পরেই না কল্কি অবতারের আগমন। অবতারবাদকে মেনে নিলেন বিধায়
তিনি ভাগবত গীতায় বিশ্বাস করলেন। ভাগবতগীতায় বিশ্বাস করলেন বিধায় তিনি জন্মান্তরবাদকেও মেনে নিলেন, কারণ ভাগবত গীতায়:-- “অবতারবাদ” এবং “জন্মান্তরবাদ” সমান গুরুত্ব পেয়েছে। জাকির নায়েক তাহলে জন্মান্তরবাদেও বিশ্বাস করে
ফেললেন! ইসলাম বিরোধী এইসব কাজ করে ইসলামের সম্মান
কি তিনি বৃদ্ধি করলেন? আর তাকে নিয়েই ওনার ভক্তদের কি উল্লাস!!
প্রশ্ন হচ্ছে:----
ক) সনাতন ধর্মে কোনো অবতার মত প্রকাশের
স্বাধীনতা হরণ করেছেন?
খ) নাস্তিককে কতল করার নির্দেষ সনাতন ধর্মের
কোনো অবতার
দিয়েছেন?
গ) সনাতন ধর্ম ত্যাগ করলে হত্যার বিধান কোনো
অবতার দিয়েছেন?
সর্বোপরি, সনাতন ধর্ম অনুযায়ী দশটি প্রধান অবতার
হচ্ছে স্বয়ং ভগবানের অবতার। তার মানে দশ
অবতারের শেষ অবতার কল্কি অবতাররুপে স্বয়ং
ভগবান অবতরণ
করবেন পৃথিবীতে। কোন সাহসে জাকির নায়েক
মুহম্মদকে কল্কি অবতার বানিয়ে দিলেন? কারণ অন্য
অবতারের মত কল্কি অবতারও স্বয়ং ভগবান, তিনি
কোনো বার্তা বাহক নন।
তাহলে জাকির নায়েকের
যুক্তি অনুযায়ী মুহম্মদ কল্কি অবতার
হলে মুহম্মদই স্বয়ং স্রষ্টা হয়ে যাচ্ছে!!! জাকির
নায়েকের এই
স্পর্ধাকে মুসলিমরা কেমনে ক্ষমা করে দিল?

Saturday, June 20, 2020

বেদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়







প্রথম পর্ব :
-------------------------

স্তুতা ময়া বরদা বেদমাতা প্রচোদয়ন্তাং পাবমানী দ্বিজানাম ।
আয়ু প্রাণং প্রজাং পশুং কীর্তিং দ্রাবিণং ব্রহ্ম বর্চসম্ ।।
মহ্যং দত্ত্বা ব্রজত ব্রহ্মলোকম ।।

ভক্তের উক্তি :
মনের উৎসাহ দাত্রী , দ্বিজদের পবিত্রকারিণী , শ্রেষ্ঠ জ্ঞান দাত্রী বেদমাতাকে আমি অধ্যায়ন করিয়াছি ।

পরমেশ্বরের উক্তি : 
আয়ু , প্রান , প্রজা , পশু , কীর্তি , ব্রহ্মতেজ
আমাতে অর্পণ করিয়া তুমি মুক্তি প্রাপ্ত হও ।।

🔥 অথর্ববেদ - ১৯/৭১/১ মন্ত্র.....................................................✍️

"বেদ" শব্দটি 'বিদ্' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন । বিদ্' ধাতুর অর্থ - 'জানা' ।  সেজন্য বেদ শব্দের ধাতুগত অর্থ - জ্ঞান বা বিদ্যা । বিদ্যা দুই প্রকার পরা ও অপরা । জগৎকারণ পরব্রহ্ম বিষয়ক অলৌকিক জ্ঞান - পরাবিদ্যা । আর জাগতিক বিষয় সম্বন্ধীয় যাবতীয় লৌকিক জ্ঞান অপরা বিদ্যা । বেদে পরা ও অপরা এই দুই বিদ্যাই উপস্থিত । সেইজন্য বেদকে সর্বজ্ঞানের ভাণ্ডার বলা হয় । প্রকৃতপক্ষে বেদের বেদত্ব পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের জন্য । পরাবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যা ।
"বিদ্' ধাতুর চারপ্রকার অর্থ হয় :

"বেত্তি বেদ বিদ জ্ঞানে"

"বিন্তে বিদ বিচারণে"

"বিদ্যতে বিদ সত্তায়ং"

"লাভে বিন্দতি বিন্দতে" 

এই চার প্রকার অর্থ হচ্ছে :

"জানা"

"বিচার করা"

"অবস্থান করা"

"লাভ করা"

যা পাঠ করলে মানুষ সত্য বিদ্যা জানতে পারে , সত্যাসত্যের বিচার করতে পারে , প্রকৃত বিদ্বান হতে পারে এবং প্রকৃত শান্তি ও আনন্দ লাভ করা সম্ভব , তার নাম বেদ ।

👉 মহর্ষি ব্যাসদেব বেদকে চারভাগে করে ।
তাঁর নিজের শিষ্য পৈলকে "ঋগ্বেদ", বৈশম্পায়ন কে "যজুর্বেদ", জৈমিনিককে "সামবেদ" এবং সুমন্ত কে "অথর্ববেদ" প্রচারের জন্য নির্বাচন করেন । বেদ অপৌরুষেয় এবং নিত্য অর্থাৎ কোন পুরুষ বা মানুষের রচিত নয় । ঋগ্বেদে পুরুষ সূক্ত বলেন - বেদ পরমেশ্বরের রচিত নহে । শ্বাস প্রশ্বাসের । মত বেদমন্ত্র স্বতঃ নির্গত । এইজন্য বেদ নিত্য ও অপৌরুষেয় ।

👉 বেদের বিভিন্ন নাম শ্রুতি , ত্রয়ী , নিগম ইত্যাদি। 'শ্রু' ধাতুর অর্থ শ্রবণ করা , সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত যাতে মানুষ সমস্ত সত্যবিদ্যা শ্রবণ করতে পারে তাঁর নাম শ্রুতি । 
তাছাড়া বেদ পূর্বে গুরুশিষ্য পরম্পরাক্রমে যুগ যুগ ধরে শ্রুত হয়ে ঋষি সমাজে প্রচলিত ছিল বলে বেদের অপর নাম শ্রুতি । আর বেদমন্ত্র তিন শ্রেণীতে বিভক্ত - ঋক , যজু , সাম অর্থাৎ  পদ্য , গদ্য , গীতি । সেই জন্য বেদকে ত্রয়ী বলা হয় । আর নিগম শব্দের অর্থ নিশ্চিতরুপে গমন করানো । যে শাস্ত্র পাঠে সাধক কে নিশ্চিতরুপে পরমেশ্বরের নিকট গমন করায় বা নিয়ে যায় তাই নিগম বা বেদ ।



দ্বিতীয় পর্ব :
-------------------------

প্রতি বেদ আবার দুই ভাগে বিভক্ত - মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ , মন্ত্রভাগের অপর নাম সংহিতা। এতে প্রধানত যাগ যজ্ঞাদি ক্রিয়ার বিধি নিষেধ , মন্ত্র ও অর্থবাদ প্রভৃতি বিষয়গুলি উল্লেখিত আছে আর সংহিতা ভাগে যে সব গূঢ় রহস্য প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত আছে , সেই সব অপ্রকাশিত অর্থ শ্রুতি নিজেই যে অংশে প্রকাশ করেছে , সেই অংশের নাম ব্রাহ্মণ । ব্রাহ্মণ ভাগে প্রধানত স্তোত্র , ইতিবৃত্ত , উপাসনা ও ব্রহ্মবিদ্যা বিষয় উল্লেখ আছে । এই অংশ গুলি গদ্যে রচিত ।

👉 এই ব্রাহ্মণাংশের অংশবিশেষকে "আরণ্যক" বলে । কারন উহা বানপ্রস্থাশ্রমে অরণ্যবাসীদের পাঠ্য ছিল । বানপ্রস্থ অরণ্যবাসীদের পক্ষে যাগযজ্ঞ কষ্টসাধ্য হওয়ায় এবং উচ্চতর জ্ঞানলাভের জন্য তাদের হৃদয় ব্যাকুল হওয়ায় আত্মোপলবদ্ধির জন্য ধ্যান , জপ , প্রার্থনা , উপাসনা ছিল তাদের মুখ্য কাজ যাগ যজ্ঞ ছিল গার্হস্থ জীবনের প্রাধান কাজ । আরণ্যকও গদ্যে রচিত ।

👉 বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ অংশ হলো উপনিষদ । উপনিষদ ব্রহ্মবিদ্যাই বিশেষ ভাবে ব্যাখ্যা করেছে । ব্রহ্মবিদ্যাই বেদের সারবস্তু , সেজন্য এর নাম বেদান্ত । অজ্ঞান নিবৃত্তি ও ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় তাই বেদান্তের অপর নাম উপনিষৎ । উপনিষদের অর্থই ব্রহ্মবিদ্যা । সংহিতা ও ব্রাহ্মণ এই দুই উপনিষদের মধ্যে রয়েছে তাই তারা সংহিতোপনিষদ বা ব্রাহ্মণউপনিষদ নামেও উল্লেখিত হয়ে থাকে ।
বেদের এই চারটে ভাগ সংহিতা , ব্রাহ্মণ , আরণ্যক ও উপনিষদ এদের মধ্যে একটি ক্রমপর্যায় আছে । যেমন প্রথমে সংহিতা , তারপর ব্রাহ্মণ, তারপর আরণ্যক ও সর্বশেষ উপনিষৎ ।

👉 সমস্ত বেদকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করা হয় - কর্মকান্ড ও জ্ঞানকাণ্ড । এরমধ্যে সংহিতা ও ব্রাহ্মণে প্রধানত কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ।  আর আরণ্যক ও উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ডেরর অন্তর্গত । এতে উপাসনা ও ব্রহ্মবিদ্যার উল্লেখ আছে । কর্মকাণ্ড জীবকে অভ্যুদয় ধনরত্নাদি ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং পারলৌকিক স্বর্গাদি ফল প্রদান করে । কিন্তু জ্ঞানকাণ্ড মানুষের চিত্তশুদ্ধি দ্বারা মুক্তি মোক্ষ দান করে ।কর্মকাণ্ড মানুষকে প্রবৃত্তি মার্গে আর জ্ঞানকাণ্ড মানুষকে নিবৃত্তি মার্গে চালনা করার প্রেরণা দিয়ে মানুষের জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করে ।



তৃতীয় পর্ব :
-------------------------

বেদমন্ত্র গুলি তিন শ্রেণীতে বিভক্ত পদ্যাত্মক মন্ত্রের নাম ঋক গদ্যাত্মক মন্ত্রের নাম যজু  এবং গানাত্মক মন্ত্রের নাম সাম । সেজন্য বেদের অপর এক নাম ত্রয়ী । ব্যাসদেব যজ্ঞে ব্যবহার্য এক এক শ্রেণীর মন্ত্রগুলিকে এক এক স্থানে বিভক্ত করে ঋক,যজু,সাম এই তিনটি বেদ গ্রন্থাকারে বিভক্ত করেছিলেন । আর যজ্ঞে ব্যবহার্য নয় অবশিষ্ট মন্ত্রগুলি যে বেদের অন্তর্ভুক্ত করলেন তাকে অথর্ববেদ বলা হয় ।

পবিত্র বেদ অনাদি ও অনন্ত, এর জ্ঞানরাশি অনাদি অনন্ত ।
ঋগ্বেদের ১০/১৯০/৩ মন্ত্রে উল্লেখ আছে -
"অউম সূর্যাচন্দ্রমসৌ ধাতা যথা পূর্বমকল্পয়ৎ"
প্রত্যেক সৃষ্টির পূর্বে আর একটি সৃষ্টি ছিল ।
অতএব যেহেতু সৃষ্টি অনাদি , সুতরাং সৃষ্টির পূর্ববর্তী বেদও অনাদি ।

👉 বেদই সনাতনের ধর্ম , বেদই সনাতনের কর্ম , এক কথায় যিনি বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন বর্তমানে তিনিই সনাতনী নামে অভিহিত হন । বেদ না মানলে তিনি সনাতন নহেন । বেদে সকল শ্রেণীর সকল হিন্দুর সর্বরকম উপাসনার সার সামগ্রী নিহিত আছে ।বৈদিক পরবর্তিকালে জগতে যত কিছু উপাসনা পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে সবই  বৈদিক উপাসনার অনুকৃত মাত্র । সেজন্য দেখিতে পাই বৈদিক ঋষিরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ তৃণ থেকে নীরাকার নির্গুণ পরব্রহ্মের পর্যন্ত উপাসনা করেগেছেন । বেদের মতে -

"সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম"
"ঈশা বাস্যামিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ"

"জগতে চেতন অচেতন যত কিছু বস্তু আছে সমস্ত কিছুর মধ্যেই ব্রহ্ম বিদ্যমান । এই পৃথিবীতে যত জাতি যত ধর্ম সসম্প্রদায় উৎপত্তি হয়েছে , সব জাতির সকল ধর্মের সার সামগ্রী বৈদিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত

বেদ মন্ত্র গুলির মধ্যে একটা নিজস্ব দুর্বার শক্তি নিহিত । তা না হলে কয়েক হাজার বছর ধরে অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও এগুলি আমাদের কাছে পৌঁছোলো কিভাবে ?



                                        🙏 নমস্তে  🙏