WELCOME TO MY BLOG "সনাতন বৈদিক ধর্ম" AND SEE SOMETHING NEW

Sunday, September 27, 2020

স্ববিরোধী বিবেকানন্দ

 

                          স্ববিরোধী বিবেকানন্দ

By অভিজিৎ ..............................................✍️


বড়ো মাপের একজন বীর সন্যাসী যখন লেখাটাও একটু বড়ো মাপের, দয়া করে সম্পূর্ণটা ধৈর্যের সাথে পড়বেন ক্ষুদ্র জ্ঞানে তো আর বড়ো মানুষদের জানা সম্ভব হয়না তাই লেখাটাও একটু বড়ো হয়ে গেলো । লেখাটি পাঠকদের ভাল লাগলে কিংবা কিছুটা চিন্তার উদ্রেগ করলেই আমি খুশি ।

স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে হিন্দুরা খুব আপ্লুত থাকেন । এমনিতে ইসলামের দোষত্রুটি ভালই দেখতে পেতেন, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের বেলায় আবেগটাই বড় হয়ে দেখা দিত । একবার স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত এক প্রবন্ধ লিখে বসলেন । এ ধরনের লেখা যা হয় আরকি – ভাল ভাল কথা সাজিয়ে চরণামৃত পরিবেশন । শুধু হিন্দুরা নয়, এমনকি যারা অসাম্প্রদায়িক বলে পরিচিত মুসলিম আছেন, তারাও বিবেকানন্দকে নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত থাকেন । যেমন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কথা বলা যায়। তিনি সারা জীবনই অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার মানুষ ছিলেন । দেশ বিদেশের খোঁজ-খবর রাখা পণ্ডিত মানুষ ছিলেন তিনি । তিনিও বিবেকানন্দকে নিয়ে খুব উঁচু ধারনা পোষণ করতেন । তিনি তাঁকে নিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলেন "মুক্তান্বেষা"-পত্রিকায় (২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা ), শিরোনাম ছিলো – স্বামী বিবেকানন্দ অফুরন্ত প্রেরণার উৎস ।

এ ধরণের লেখায় যে আমার বড় একটা আপত্তি আছে তা নয় । তবে এই চরণামৃত লেখাগুলোর দুর্বলতা হল, এতে থাকে গভীর বিশ্লেষণের অভাব । তাহলে কী থাকে এ ধরনের সপ্রশংস লেখাগুলোতে ? থাকে বিবেকানন্দ কত মহান ছিলেন, কত বড় সাধক ছিলেন, কত বড় তার দেশপ্রেম ছিল, জীবে তার কত দয়া ছিলো, সামাজিক কুসংস্কার দূর করাতে তার কত আগ্রহ ছিলো, জাতিভেদ বাল্যবিবাহ, সতীদাহ দূর করার জন্য সাধারণ মানুষের জন্য কত কাজ করেছেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে কত আগুন ঝরা বক্তৃতা দিয়েছেন ইত্যাদি । এ লেখাগুলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিবেকানন্দের বলা বহু ব্যবহারে জীর্ণ কিছু বাণীকে সামনে নিয়ে আসা হয় –

👉 জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ।

👉 খালি পেটে ধর্ম হয় না, ক্ষুধার্ত জনগণকে ধর্ম উপদেশ দেয়া অবমাননাকর ।

👉 হে ভারত ভুলিও না মেথর, মুচি চণ্ডাল তোমার ভাই ।

👉 ব্রিটিশ সভ্যতা তিনটি "ব"-এর সমষ্টি – "বাইবেল", "বেয়নেট" ও "ব্র্যাণ্ডি" ।

👉 আমি সন্ন্যাসী, তাই জগতে নিজেকে প্রভু নয়, দাস বলেই মনে করি ।

ইত্যাদি ……..................................................✍️

এ কথাগুলো শুনতে ভালই লাগে । মনে হয় কত মহৎ সব কথা । কিন্তু বার বার বহুভাবে চর্চিত বাণীগুলোর পাশাপাশি সম্পূর্ণ বিবেকানন্দকে জানার জন্য তার রচনাবলীর দিকে সংশয়ী দৃষ্টি দিলেই জাগবে চোখ ধাঁধানো বিভ্রম । দেখা যাবে উপরে যে ভাল ভাল কথামালার লিস্টি ঝোলানো হয়েছে, প্রতিটি বানীরই ঠিক একশত আশি ডিগ্রী বিপরীত কথা আবার তিনিই বলে গেছেন । এক দিকে জীবপ্রেমের গান শুনাচ্ছেন তো অন্যদিকে নিজেই বরাহনগর মঠে পশুবলি প্রবর্তন করেছেন । একদিকে চণ্ডালদের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন তো অন্যদিকে আবার বলছেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মনেরাই চরম আদর্শ’। একদিকে বাল্য বিবাহকে খারাপ বলছেন তো পর-মুহূর্তেই আবার বলছেন, ‘বাল্য বিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করেছে’। একবার কুসংস্কার দূর করার জিকির তুলছেন তো একই মুখে আবার জন্মান্তর, আত্মা আর জাতিভেদ জিইয়ে রাখার পক্ষে সাফাই গাইছেন । একবার নিজেকে সন্ন্যাসী বলে জাহির করেছেন তো আরেকবার ভোগ, বিলাস ব্যসনে আর রাজ রাজাদের গৃহে গিয়ে উদরপূর্তিতে অফুরন্ত সময় ব্যয় করেছেন । কিন্তু ভক্তকুলের নিবিষ্ট প্রচেষ্টায় সেই বিপরীত কথাগুলো কিংবা তার স্ববিরোধী কাজগুলোকে সযত্নে আড়াল করে ফেলা হয়েছে । ভক্তকুলের অহর্নিশি স্তব, ফুল চন্দন আর নানাবিধ প্রশংসায় বিবেকানন্দ এখন পরিণত হয়েছেন ‘যুগ নায়ক’-এ, ‘অফুরন্ত প্রেরণার উৎসে’ । কিন্তু যুগ-নায়কের হলুদ গৈরিক বসনের লেবাস একটু ঠ্যালা মেরে সরিয়ে দিলেই বের হয়ে পড়ে নানা ধরনের ভণ্ডামি আর স্ববিরোধিতার নগ্ন-রূপ । বেরিয়ে পড়ে চালেডালে মেলানো মেশানো অদ্ভুত খিচুড়ি বিবেকানন্দের আসল স্বাদটুকু । কিন্তু এই খিচুড়ির পূর্ণাংগ রসালো স্বাদ পেতে চাইলে বিবেকানন্দকে খণ্ডিত-ভাবে না জেনে সামগ্রিকভাবে জানতে হবে, আগাগোড়া পড়তে হবে তার ‘বাণী ও রচনা’, ‘পত্রাবলী’, নিবেদিতার লেখা ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’, শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি বইগুলো । যারা স্তবের আলো থেকে সরে নির্মোহ ভাবে বিবেকানন্দকে জানতে চান, তারা সংগ্রহে রাখতে পারেন নিরঞ্জন ধরের লেখা ‘বিবেকানন্দ : অন্য চোখে’ (উৎস মানুষ সংকলন) বইটি কিংবা রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ : মুক্তমনের আলোয়’ (র‍্যাডিকাল প্রকাশনী, কলকাতা) বই দুটো । গোলাম আহমাদ মোর্তজার লেখা ‘বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ’ (বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন) এবং প্রবীর ঘোষের অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড, দ্বে’জ প্রকাশনী) বইটিতেও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যাবে ।

‘জীবে প্রেম করে যেই জন’ বনাম পশুবলি

বিবেকানন্দকে নিয়ে আমার খটকার সূচনাটা হয়েছিলো প্রবীর ঘোষের অলৌকিক নয় লৌকিক বইটির (প্রথম পর্ব) মাধ্যমেই। একটি বই মানুষের জীবনকে কতভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার সার্থক উদাহরণ ছিল আমার জীবনে এই বইটি। ছেলেবেলায় এই বইটি পড়া না হয়ে উঠলে আমি এই আজকের আমি হয়ে উঠতাম কীনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে আমার। অলৌকিকতা, পারলৌকিকতা আর যাবতীয় ভাঁওতাবাজির গোমড় ফাঁস করার ব্যাপারগুলো তো আছেই, সেই সাথে প্রবীর ঘোষ আরেকটা বড় ব্যাপার করেছিলেন এ বইটির মাধ্যমে। মহাপুরুষ কিংবা মহামানব বলে কথিত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার দিক সামনে নিয়ে এসেছিলেন, ভেঙ্গে ফেলেছিলেন সেই চিরন্তন মিথটি – মহাপুরুষ হলেই তাকে দেবতা বানিয়ে একেবারে মাথায় করে রাখতে হবে! প্রবীর ঘোষের ‘মিথ ব্লাস্টার’ তালিকায় ছিলেন রামকৃষ্ণ, ঋষি অরবিন্দ, সত্যেন বোস, অনুকূল চন্দ্র, গান্ধী সহ অনেকেরই অতিরঞ্জিত মিথ । [০১]

স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন তার সমালোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে। যেমন, বিবেকানন্দ রচনাবলী (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক নবপত্র, পৃঃ২৬৪ ) থেকে উদ্ধৃত করে প্রবীর ঘোষ দিয়েছেন বিবেকানন্দের অবৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভট চিন্তার উদাহরণ – অন্ধকার ঘরে ইস্পাতের পাতের উপর শক্তি প্রয়োগ করলে নাকি পাতটা চৈতন্য বা মনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। প্রবীর ঘোষ লিখেছেন [০২] 

“একটি ইস্পাতের পাত গড়ে, তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটি অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, তবে তুমি প্রথমে শুনতে পাবে একটি শব্দ – একটি গুন গুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত কর, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠছে। শক্তি আরো বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।”

কি, এই কথাগুলো মেনে নিতে পারছেন না? একটা ইস্পাতের পাত নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেই তো পারেন। মনে রূপান্তরিত হয়েছে কিনা কি করে বুঝবেন? কেন ই.সি.জি মেশিনের সাহায্যে।

পরীক্ষায় ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হচ্ছে না? অদৃশ্য হচ্ছে না? উল্টো-পাল্টা বিজ্ঞানবিরোধী আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছি বলছেন? আমাকে এর জন্য ধিক্কার দেবেন নাকি? একটু থামুন। শুনুন, এমন একটা তথ্যের বা তত্ত্বের জন্য প্রশংসা বা নিন্দা কোন কিছুই আমার প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য বিবেকানন্দের। বিবেকানন্দ রচনাসমগ্রের উল্লেখিত বইটির ২৬৪ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দের বক্তব্য হিসেবেই এমন উদ্ভট কথা লেখা হয়েছে ।

সেই থেকে শুরু। প্রথমে ভেবেছিলাম স্বামীজী বিজ্ঞান হয়তো ভাল জানতেন না, তাই দু-এক জায়গায় হয়তো উল্টো-পাল্টা কিছু লিখেছেন। সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যাপারগুলোতে নিশ্চয় এমনতর গুবলেট করেননি। তারপরও এক ধরণের সংশয়ী মন নিয়েই বিবেকানন্দ পড়া এবং জানার চেষ্টা করলাম। প্রথমে পড়লাম বিবেকানন্দ সমগ্র, এরপরে পড়লাম আরো আনুষঙ্গিক বইপত্র। এই অযাচিত আগ্রহ আর বেত্তমিজির ফল খুব একটা সুখপ্রদ হল না; যা বেড়িয়ে এলো তা রীতিমত চমক! স্তব আর মোহের স্তর সরিয়ে যে বিবেকানন্দকে আমি খুঁজে পেলাম, তিনি আগা-পাশ-তলা আদ্যোপান্ত এক স্ববিরোধী বিবেকানন্দ। এ নিয়ে আগে কারো কারো সাথে বিতর্ক করতে গিয়ে মন্তব্য আকারে কিছু লিখেছিলাম (যেমন এখানে কিংবা এখানে), তবে পূর্ণাঙ্গ আকারে বাংলায় কিছু লেখা হয়নি। আমার আজকের এই প্রবন্ধে খণ্ডিত নয়, পূর্নাঙ্গ ভাবে স্বামী বিবেকানন্দকে দেখবার একটি প্রচেষ্টা নেয়া হল ।

জীব প্রেম নিয়ে স্বামীজীর অমিয় বাণীটির কথা আমরা সবাই জানি । স্বামীজী বলেছেন –

👉 "বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর

জীবে প্রেম করে যেই জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর"

ভাল কথা। কিন্তু আমি ইতিহাস ঘেঁটে দেখলাম, এই বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে ১৮৮৬ সালে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ‘বরাহনগর মঠে’র প্রতিষ্ঠার পরে সেখানে মহা উৎসাহে পশুবলি পবর্তন করেছিলেন। অধিকাংশ গুরুভাইদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি সর্বদাই দেবী পূজায় পশুবলির ব্যবস্থা রাখতেন। এমনকি বেলুড়মঠের দুর্গাপূজাতেও তিনি পাঁঠাবলি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার গুরু রামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদা দেবী আপত্তি করলে তিনি তা করতে পারেননি [০৩] ।

কিন্তু বেলুড় মঠে করতে না পারলেও কালিঘাট থেকে বলি দিয়ে পাঁঠা নিয়ে এসে ভোজনের আয়োজন করতেন। পরবর্তী জীবনে আমরা আরো দেখি তার ইংরেজ শিষ্য নিবেদিতাকে দিয়ে বিভিন্ন জনসভায় পশুবলির সমর্থনে বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন [০৪]।

বিবেকানন্দের জীবপ্রেমের কি অত্যাশ্চর্য নমুনা! একজন বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী হিসেবে সমগ্র জীবজগতকে ভালবাসার উপদেশের সাথে পশুবলি একেবারে অসঙ্গতিহীন, তা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে। শুধু তাই নয় , বিবেকানন্দ বললেন [০৫] -

"আরে একটা পাঁঠা কী, যদি মানুষ বলি দিলে যদি ভগবান পাওয়া যায়, তাই করতে আমি রাজি আছি"।

অর্থাৎ কল্পিত ভগবানকে পাওয়ার জন্য দরকার হলে মানুষকে পর্যন্ত বিবেকানন্দ বলি দেবেন! এই না হলে ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’।

বিবেকানন্দের নারী ভাবনা....................................... ✍️

বিধবা-বিয়ে বিরোধিতা এবং বাল্য বিবাহ আর সহমরণ সমর্থন

বাল্যবিবাহ নিয়ে বিবেকানন্দের দড়ি টানাটানির নমুনা আরো এককাঠি মজাদার। বিবেকানন্দের একটি উক্তিকে খুব বড়াই করে সামনে নিয়ে আসেন বিবেকানন্দ ভক্তরা [০৬] – 

”বাল্যবিবাহের উপর আমার প্রবল ঘৃণা”

এমনকি বিবেকানন্দ এও বলেছেন [০৭] -

“বাল্যবিবাহ দেয় এমন মানুষকে খুন পর্যন্ত করতে পারি”।

অথচ, সেই বিবেকানন্দই আবার আরেক জায়গায় গণেশ উল্টিয়ে দিয়ে বলেছেন [০৮]–

"বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে"।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিয়ে দিয়ে হিন্দুদের কুসংস্কার দূর করাতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন, তখন বিবেকানন্দ শোনাচ্ছেন অন্য কথা, অন্য গান [০৯] -

"বিধবাদের পুনর্বিবাহ দিলে কুমারী মেয়েদের ভাগ্যে স্বামী কম পড়ে যাবে" এবং "বিধবাগনের স্বামী সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না" এবং এও বলেছেন - "বিধবাবিবাহ আন্দোলনে শতকরা সত্তর জন ভারতীয় নারীর কোন স্বার্থই নাই"

এ জায়গায় পাশ্চাত্য মেয়েদের প্রশংসা করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বলছেন [১০]

"এ দেশের (আমেরিকা) স্ত্রীদের মত স্ত্রী কোথাও দেখিনি … এরা কেমন স্বাধীন। এদের মেয়েরা কি পবিত্র । ২৫-৩০ বছরের কমে কারুর বিয়ে হয় না । আর আমরা কি করি ? আমার মেয়ের ১১ বৎসরে ‘বে’ না হলে খারাপ হয়ে যাবে ! আমরা কি মানুষ ?"

আবার পরক্ষণেই ভারতীয় মেয়েদের আকাশে তুলে আর পাশ্চাত্যের মেয়েদের যা-তা বিশেষণে বিশেষিত করে লিখেছেন [১১]

ওদেশে (পাশ্চাত্যে) মেয়েদের দেখে আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলেই বোধ হত না – ঠিক যেন পুরুষ মানুষ । গাড়ী চালাচ্ছে , স্কুলে যাচ্ছে , প্রফেসরি করছে । একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা , বিনয় প্রভৃতি দেখে চক্ষু জুড়ায় ।

বাল্যবিবাহ যে আসলে ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘কত ভাল’, তা আমরা প্রত্যক্ষ করি বিবেকানন্দের নানা কুসংসারাচ্ছন্ন উক্তিতে, যেখানে তিনি বলছেন ‘প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হইবার পূর্বে বাল্যকালে’ বিয়ে দেয়া ভাল হবে, নইলে হবে ঘোর ‘অনর্থ’ [১২] –

কখনো কখনো শিশু বয়সেই আমাদিগকে বিবাহ দেওয়া হয় , কেননা বর্ণের নির্দেশ । মতামতের অপেক্ষা না রাখিয়াই যদি বিবাহের ব্যবস্থা করিতে, তবে প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে বিবাহ দেয়া ভাল । যদি অল্প বয়সে বিবাহ না দিয়া ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে বাড়িতে দেয়া হয়, তবে তাহার এমন কাহারো প্রতি আসক্ত হইতে পারে, যাহাদের সহিত বিবাহ বর্ণ অনুমোদন করিবেন না । সুতরাং তাহাতে অনর্থের সৃষ্টি হইতে পারে। সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ হইলে, বালক-বালিকার ভালবাসা রূপ-গুণের উপর নির্ভর না করিয়া স্বাভাবিক হইবে ।

‘প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে’ বিয়ে দেয়ার পরামর্শটা বিবেকানন্দের কোন হাল্কাচালে করা আপ্তবাক্য ছিলো না, ছিল চিন্তাশীল বাক্যই। আসলে মানুষের স্বাভাবিক প্রেম ভালবাসা নিয়ে তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় শুচিবায়ুগ্রস্ত। তিনি মনে করতেন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কেউ বিয়ে করলে তার সন্তান নাকি হবে আসুরিক বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন । তিনি বলেছেন [১৩] -

“যদি কাউকে ইচ্ছেমত পতি বা পত্নীরূপে গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ এবং পাশবপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির চেষ্টা সমাজে বিস্তার লাভ করে, তার ফল নিশ্চয় অশুভ হবে- দুষ্টপ্রকৃতি, অসুর ভাবের সন্তান জন্মাবে।”

কাজেই যে স্বাধীনচেতা ছেলে মেয়েরা ইচ্ছেমত প্রেম ভালবাসা আর ডেট-এর মাধ্যমে প্রণয় কিংবা বিয়ের জন্য সঙ্গি খুঁজে নিচ্ছেন , তাঁদের এখন থেকেই আসুরিক সন্তানের আশঙ্কায় অপকর্ম থেকে নিবৃত হওয়া উচিৎ, কী বলেন ।

আসলে প্রেম ভালবাসা বিয়ে প্রভৃতি নিয়ে কোন যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেকানন্দের মধ্যে কখনোই গড়ে উঠেনি। তিনি নিজে ছিলেন চিরকুমার, আজীবন বিয়ে-থা করেননি । নিজে তো বিয়ে করেননি-ই , অন্যদের বিয়ে করতে দেখলেও তার মেজাজ বিগড়ে যেত । এমনকি নিজের ভাই মহেন্দ্রনাথের বিয়ের যখন কথা চলছিল , তিনি এমন রেগে গিয়েছিলেন যে , বলেছিলেন তার সাথে কোন সংশ্রব রাখবেন না । তার উক্তিতেই [১৪] –

“এ বিষয়ে আমার একটিমাত্র সিদ্ধান্ত থাকিতে পারে – নিন্দা ! বালক-বালিকা-যাহারাই হউক না কেন, আমি বিবাহের নাম পর্যন্ত ঘৃণা করি । তুমি কি বলিতে চাও আমি, আমি একজনের বন্ধনে সহায়তা করিব ? কি আহাম্মক তুমি ! যদি আমার ভাই মহিন (মহেন্দ্রনাথ) আজ বিয়ে করে, আমি তার সাথে কোন সংস্রব রাখব না । এ বিষয়ে আমি স্থির সংকল্প ।”

আরেকবার বিবাহোন্মুখ মাদ্রাজীদের সম্পর্কে অযথাই ‘যোনিকীট’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন, আর তাঁদের বিয়েকে তুলনা করেছিলেন বেশ্যালয়ে গমনের সাথে এভাবে [১৫] –

“মাদ্রাজীরা অপেক্ষাকৃত চটপটে ও দৃঢ়তা সহকারে একটা বিষয়ে লাগিয়া থাকিতে পারে বটে। কিন্তু হতভাগাগুলো সকলেই বিবাহিত। বিবাহ! বিবাহ! বিবাহ! পাষণ্ডেরা যেন ঐ একটা কামেন্দ্রিয় লইয়া জন্মাইয়াছে – যোনিকীট – এদিকে আবার নিজেদের ধার্মিক এবং সনাতন পন্থাবলম্বী বলিয়া পরিচয়টুকু দেয়া আছে । অনাসক্ত গৃহস্থ হওয়া অটি উত্তম কথা, কিন্তু উহার ততটা প্রয়োজন নাই, চাই এখন অবিবাহিত জীবন! যাক, বলাই! বেশ্যালয়ে গমন করিলে লোকের মনে ইন্দ্রিয়াসক্তির যতটা বন্ধন উপস্থিত হয়, আজকালকার বিবাহ প্রথায় ছেলেদের ঐ বিষয়ে প্রায় তদ্রূপ বন্ধনই উপস্থিত হয়। এ আমি বড় শক্ত কথা বলিলাম।”

প্রেম ভালবাসা বিয়ে নিয়ে বিবেকানন্দের এই বিকৃত মনোভাবের কারণ যে কী এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার ধারণা এর পেছনে তার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের প্রলাপের কিছুটা হলেও প্রভাব আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন এক অশিক্ষিত, মূলতঃ মানসিক বিকারগ্রস্ত এক সাধক, যাকে নিয়ে ভারতবাসীরা এখনো যার পর নাই গর্বিত। এই প্রায়-অর্ধোন্মাদ সাধক বলতেন তিনি সাধনায় মা কালীর সাথে এক্কা দোক্কা খেলেন; সাধনা করতে করতে প্রায়ই মূর্ছা যেতেন তিনি। আজকের দিন হলে তাকে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে পাঠিয়ে হিস্টিরিয়ার চিকিৎসা করা হত নিঃসন্দেহে। তার আধ্যাত্মিকতা কিংবা অসুস্থতা – কোনটা নিয়েই আমার অবশ্য কোন আগ্রহ নেই। আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। নারী সম্পর্কে তার মনোভাব ছিলো খুবই সনাতন। নারীকে তিনি মনে করতেন ‘নরকের দ্বার’ [১৬] –

‘কামিনী নরকস্য দ্বারম্‌। যত লোক স্ত্রী লোকের বশ’।

নারী সম্বন্ধে সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের আরো কিছু ‘কথামৃত’ শ্রবণ করা যাক [১৭] –

মেয়ে মানুষের কাছে খুব সাবধান হ’তে হয় । মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে ।

আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে। আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি! সব রাক্ষসীর মত দেখি।

মেয়ে মানুষের শরীরে কি আছে – রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়ীভুঁড়ি, কৃমি, মূত্র, বিষ্ঠা এই সব। সেই শরীরের উপর ভালবাসা কেন?

দেখ না, মেয়ে মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিনী মেয়েদের! পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয় । যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ এক সঙ্গে ব’সে আছে, তখন বলি, আহা ! এরা গেছে ।

হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশীক্ষণ কাছে বসতে দেই না। একটু পরে হয় বলি – ‘ঠাকুর দেখো গে যাও’; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি ।

যদি স্ত্রীলোক ভক্তিতে গড়াগড়ি যায় , তবুও তার কাছে যাতায়াত করবে না ।

মেয়ে মানুষের সঙ্গে থাকলেই তাঁদের বশ হয়ে যেতে হয় ।

মেয়ে ভক্তদের গোপাল ভাব - ‘বাৎসল্য ভাব’ বেশি ভাল নয় । ঐ ‘বাৎসল্য’ থেকেই আবার একদিন ‘তাচ্ছল্য’ হয় ।

মেয়ে মানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাঁদের হাওয়া গায় লাগে।

আমি নিশ্চিত কেউ যদি আজকে এই বাক্যগুলো লিখতেন কিংবা বলতেন তাকে পাগল ঠাউরিয়ে হেমায়েতপুরে পাঠানোর সকল ব্যবস্থা করা হত। অথচ হিন্দু ধর্মের গর্বে গর্বীরা তাঁকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সাধকের সম্মান । অশিক্ষিত এই সাধককে নিয়ে অতি সুশিক্ষিতরাও হয়ে পড়েন হতবিহবল; বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিশাল মর্মরমূর্তি গড়ে চলে ধুম ধারাক্কা পূজা-অর্চনার যাবতীয় আয়োজন ।

চিত্র - বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ পরমহংসের মর্মরমূর্তি

রামকৃষ্ণ মনেই করতেন , মেয়েদের লজ্জাই হওয়া উচিৎ একমাত্র ভূষণ । আরো বলতেন, ভাল মেয়ে সেই, যার কাম ক্রোধ ঘুম এসব কম, আর স্নেহ, মায়া লজ্জা এসব বেশি থাকে । একবার শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম গৃহীভক্ত শ্রী মহেন্দ্র গুপ্তের বাড়ির নয়-দশ বছরের দুটি মেয়ে এসে একবার রামকৃষ্ণকে দুটো ভক্তি-গীতি শুনিয়েছিলেন । সেই গান শুনে ঠাকুর বড়ই আনন্দিত হন । তারপর আরেকদিন সেই মেয়ে দুটো কাশীপুর বাগানে ঠাকুরকে গান শোনানোর সময় ভক্তরাও সেটা শুনে ফেলে, আর তাঁদের ডেকে নিয়ে তারাও গান শোনে । তখন শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার মেয়েদের আর গান শিখিও না। যার তার কাছে গাইলে লজ্জা ভেঙ্গে যায় । লজ্জা মেয়েদের বড় দরকার’।

লজ্জা যে মেয়েদের খুবই দরকার, আর গান গাওয়া কিংবা মঞ্চে ওঠা মেয়েদের যে লজ্জা ফজ্জা থাকে না, তারা যে খারাপ মেয়ে – এই মানসিকতা শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভক্তরা আজো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন তাঁদের মননে এবং আচরণে। একটা উদাহরণ দেই। ১৯৯৪ সালের দৈনিক আজকালের একটা খবর থেকে জানা যায়, বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ‘লোককৃষ্টি’ নামের একটি নাটকের দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েও শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি। কারণ – ঐ দলে কিছু নারী শিল্পী ছিলেন। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিতর্ক শুরু হলে মিশনের প্রধান জানান [১৮],

‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কোন অনুষ্ঠানে মহিলারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারেন না । ১৮৯৭ সালে স্বামীজি যখন বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তখন থেকেই এই ঐতিহ্য এবং ভাবধারা বহমান। বেলুড় মঠের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ভাবধারা মেনেই ঐ অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি’।

মিশনের প্রধান ভুল কিছু বলেননি । তিনি নিয়মনিষ্ঠ ভাবে রামকৃষ্ণের সেই ‘নারীরা নরকের দ্বার’ নামক ঐতিহ্যই অনুসরণ করেছেন। আসলে নারীদের নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা আর যৌন-ভীতি ছিলো । তিনি সকল স্ত্রী লোককে নাকি ‘মা হিসেবে’ দেখতেন- এমনকি তার নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকেও । বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীকে একটা সময় পরে তিনি ‘ভাই বোনের’ মত থাকার পরামর্শ দিতেন –

‘স্ত্রী লোক কিরূপ জান ? যেমন - আচার তেঁতুল । মনে করলে মুখে জল সরে । আচার তেঁতুল সম্মুখে আনতে হয় না । … আপনারা যতদূর পার স্ত্রীলোকের সাথে অনাসক্ত হয়ে থাকবে । মাঝে মাঝে নির্জন স্থানে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করবে । সেখানে যেন ওরা কেউ না থাকে । ঈশ্বরেতে বিশ্বাস ভক্তি এলে অনেকটা অনাসক্ত হয়ে থাকতে পারবে । দু-একটি ছেলে হলে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনে ভাইবোনের মত থাকবে । আর ঈশ্বরকে সর্বদা প্রার্থনা করবে, যাতে ইন্দ্রিয় সুখেতে মন না যায়, ছেলেপুলে আর না হয়’।

নিজের স্ত্রীকে মা ডাকা, বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীদের ভাই-বোনের মত থাকার পরামর্শ দেয়া – এই নির্বোধ পাগলামি মনে হয় কেবল রামকৃষ্ণের পক্ষেই সম্ভব । তার পক্ষেই বলা সম্ভব – ‘যে বীরপুরুষ, সে রমণীর সাথে থাকে, না করে রমণ’। এটা নিঃসন্দেহ যে, রামকৃষ্ণের জীবন-চর্চায় যারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার বাণী অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন, তাঁদের সুস্থ স্বাভাবিক যৌন-জীবন ব্যহত হতে বাধ্য। এর কোন ব্যত্যয় নেই। রামকৃষ্ণের অন্ধ-স্তাবকেরা অবশ্য মিন মিন করে বলার চেষ্টা করেন – ‘আচার-তেঁতুল’ বলে নারীসঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারটা কিংবা রমণ না করার মত উক্তিগুলো নাকি কেবল সন্ন্যাসীদের কথা মাথায় রেখে বলেছেন, সংসারী মানুষের জন্য নয়। এটা ভুল ব্যাখ্যা। ‘যে বীরপুরুষ, সে রমণীর সাথে থাকে, না করে রমণ’ – রামকৃষ্ণের এই নির্দেশ কোন সন্ন্যাসীর প্রতি ছিলো না, ছিলো তার অন্যতম গৃহীভক্ত ভবনাথের প্রতি [১৯]।

তার অপর এক গৃহীভক্ত বিনোদকে রামকৃষ্ণ স্ত্রীর সাথে না শুতে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন[২০] –‘

দেখো, সঙ্গ হোক, আর না হোক, একসাথে শোয়াও খারাপ। গায়ের ঘর্ষণ, গায়ের গরম’। আজকের দিনের স্বামীরা রামকৃষ্ণের এই উপদেশগুলো মানলে তাঁদের সংসারে কী বিপত্তি নেমে আসবে, তা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে ।

নারীদের নিয়ে নিজের মনেই এক ধরণের যৌন-ভীতি তৈরি করে অস্বাভাবিক উপায়ে কাম জয়ের চেষ্টা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ যে সফল হননি, তা বলাই বাহুল্য। তার স্বীকৃতি মেলে তার নিজের করা উক্তিতেই [২১] –

‘ওরে ভগবদ্দর্শন না হলে কাম একেবারে যায় না। তা (ভগবানের দর্শন) হলেও শরীর যতদিন থাকে ততদিন একটু-আধটু থাকে, তবে মাথা তুলতে পারে না। তুই কি মনে করিস, আমারই একেবারে গেছে? একসময় মনে হয়েছিল কামটাকে জয় করেছি। তারপর পঞ্চবটিতে বসে আছি।, আর ওমনি কামের এমন তোড় এলো যে আর যেন সামলাতে পারিনি! তারপর ধুলোয় মুখ ঘষড়ে কাঁদি আর মাকে বলি – মা , বড় অন্যায় করেছি আর কখনো ভাবব না যে কাম জয় করেছি -’

কাম জয়ের চেষ্টায় সফল না হলেও, অস্বাভাবিক উপায়ে কাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার ফলে তার মনে তৈরি হয় নারী আর কাম নিয়ে নানা মানসিক বিকারগ্রস্থতা। এ জন্যই তিনি সারদামনির সাথে কোন সুস্থ যৌনসম্পর্ক কখনোই গড়ে তুলতে পারেননি। দক্ষিণেশ্বরে এ প্রায় ৮ মাস এক শয্যায় শয়ন করার পরেও স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক করতে পারেননি, বরং ‘ঠাকুর শ্রী শ্রী মাতাঠাকুরাণীর অঙ্গ স্পর্শ করতে উদ্যত হইবামাত্র মন কুণ্ঠিত হইয়া সহসা সমাধিপথে এমন বিলীন হইয়া গেল যে, সে রাত্রিতে উহা আর সাধারণ ভাবভূমিতে অবরোহণ করিল না … দেহবোধ বিরহিত ঠাকুরের প্রায় সমস্ত রাত্রি এইকালে সমাধিতে অতিবাহিত হইত’ [২২]।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আর মনস্তত্ত্বের নিরিখে বিচার করলে এই যৌন-ভীতি থেকে উদ্গত সমাধিকালকে ‘কনভারশন হিস্টিরিয়া’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না [২৩]।

যৌনতা সংক্রান্ত মানসিক নানা টানাপোড়নের ফলে তিনি দেহবোধ বিরহিত শারীরিকভাবে অক্ষম এক পুরুষে পরিণত হন, আর তা ঢাকতে নিজের স্ত্রীকে মা ডাকা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে তোলা সহ নানা আজগুবি ধ্যান-ধারনার উন্মেষ ঘটান আর তার শিষ্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হন ।

যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে গুরু এবং আদর্শ হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে গুরুর আদর্শ দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প হাতে তুলে নিয়েছেন, সেই বিবেকানন্দ মনে প্রাণে আর কতটুকুই বা ব্যতিক্রম হবেন? তারপরেও বিবেকানন্দ যে নারীদের নিয়ে ভাল কথা বলেননি তা নয়। বিপ্লব পাল সম্প্রতি মুক্তমনায় প্রকাশিত তার একটি লেখায় স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজিতে করা কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন [২৪] –

“The best thermometer to the progress of a nation is its treatment of its women.”

” There is no chance for the welfare of the world unless the condition of women is improved.”

“Woman has suffered for aeons, and that has given her infinite patience and infinite perseverance.”

“The idea of perfect womanhood is perfect independence.”

বিবেকানন্দের বলা এই ‘perfect independence’ যে তিনি নারী স্বাধীনতার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব, তা স্পষ্ট করেছেন আরো অনেক উদ্ধৃতিতেই –

‘বিকশিত হবার প্রথম শর্তই হল স্বাধীনতা। এটা খুবই অন্যায়, সহস্রবার অন্যায়, যদি তোমাদের মধ্যে কেউ এ কথা বলার দুঃসাহস রাখে যে, আমি নারী এবং শিশুর মুক্তিসাধন করব’।

তিনি মেয়েদের শিক্ষিত হবার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন, মেয়েদের সমস্যা বিষয়ে বলবার অধিকার পুরুষের নয়, কেবল নারীদের হাতেই সেটা থাকা উচিৎ তার ইঙ্গিত করেও বলেছেন –

‘প্রথমে তোমাদের নারী জাতিকে শিক্ষিত করে তুলে তাদের ব্যাপার তাঁদের উপরেই ছেড়ে দাও; তখন তারাই তোমাদেরকে বলবে তাঁদের জন্য কোন কোন সংস্কার প্রয়োজন । তাদের ব্যাপারে তোমরা মাথা গলাবার কে ?’

এই উক্তিগুলো পড়ে বিবেকানন্দকে খুব প্রগতিশীল, নারী স্বাধীনতার ‘অগ্রদূত’ টাইপ বলে কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু সেই ইমেজ পরক্ষণেই ধূলিস্ম্যাৎ হয়ে যায়, যখন আমরা শুনি, বিবেকানন্দই আবার অন্য মুখে বলছেন [২৫] –

‘হে ভারত ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী ও দয়মন্তি’।

যে স্বামীজী নারী স্বাধীনতার জন্য এতো অন্তপ্রাণ, তিনিই আবার সীতার মত পতিব্রতা হয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন; সীতা, সাবিত্রী দয়মন্তিদের আদর্শ মেনে চলার জন্য মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করছেন । তিনি বলছেন [২৬],

‘আমাদের নারীগণকে আধুনিক-ভাবে গড়িয়া তুলিবার যে সকল চেষ্টা হইতেছে সেইগুলির মধ্যে যদি সীতা-চরিত্রের আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা থাকে, তবে সেগুলি বিফল হইবে। … ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতি বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই একমাত্র উন্নতির পথ’।

সীতার মত পতিব্রতা নারী স্বামিজীর পছন্দ ছিল বলেই কীনা জানিনা, সতীদাহ কিংবা সহমরণের মত ঘৃণ্য প্রথাকেও তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্থন করেছেন । সতীর আদর্শকে মহান প্রতিপন্ন করতে গিয়ে বলেছেন [২৭] –

এই আদর্শের চরম অবস্থায় হিন্দু বিধবারা সহমরণে দগ্ধ হতেন।

সহমরণের সমর্থনে তার আরো অনেক সুস্পষ্ট উদ্ধৃতিই হাজির করা যাবে। যেমন [২৮] –

‘প্রথমে সেই ভাবটাই উস্কে দিয়ে তাঁদের (হিন্দু নারীদের) character form করতে হবে – যাতে তাঁদের বিবাহ হোক বা কুমারী থাকুক, সকল অবস্থাতেই সতীত্বের জন্য প্রাণ দিতে কাতর না হয়। কোন একটা ভাবের জন্য প্রাণ দিতে পারাটা কি কম বীরত্ব ?’

স্বামী বিবেকানন্দ যে সহমরণ সমর্থন করতেন, তা ভগ্নি নিবেদিতার ভাষ্যেও স্পষ্ট হয় [২৯] –

‘জগতের চোখে সহমরণ এত বড় প্রথা কেন – কারণ ওতে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়’।

স্বামীজি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগরের বিধবা বিয়ে নিয়েও ছিলেন দারুণ বিরূপ। ১৯০০ সালের ১৮ই জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ায় ভারতের নারীদের নিয়ে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, যেহেতু পুরুষের চেয়ে নারীরা সংখ্যায় বেশি, সেহেতু বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হলে নাকি ‘কুমারী মেয়েদের স্বামী মিলবে না’।

স্বামীজির এই সারবত্তাহীন বক্তব্য জাকির নায়েকের ‘জোকারি মূলক’ উক্তির সমতুল্য, যেখানে তিনি পুরুষের বহুবিবাহকে বৈধতা দিতে চান পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাধিক্য টেনে এনে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই সত্য নয়। সারা পৃথিবীতে নারী এবং পুরুষের অনুপাত হল ১ :১.০১ । পুরুষেরাই বরং সামান্য হলেও সংখ্যায় অধিক। এমনকি ভারতের ক্ষেত্রেও স্বামীজির বক্তব্য যে অসার তা দৈনিক আজকালে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সম্পাদিকা সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৪ সালের ৮ ই এপ্রিল [৩০] 

(সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ নির্মোহ চিঠিকে এবং তার পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদী পাঠকদের জবাবকে কেন্দ্র করে দৈনিক আজকাল পত্রিকায় ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিলো, যেগুলো পরবর্তীতে সংকলিত হয়েছে রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ : মুক্ত মনের আলোয়’ শীর্ষক গ্রন্থে । উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন)-

‘১৯০১ সালের সেন্সাস অনুজায়ই ভারতীয় নারী-পুরুষের অনুপাত হল ৯৭২ : ১০০০। অর্থাৎ, প্রতি একহাজার জন পুরুষ পিছু ৯৭২ জন নারী। সুতরাং স্বামীজি তার স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারী পরিসংখ্যানকে শুধু বিকৃত করেননি, বিদ্যাসাগরের মত একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’কেও অস্বীকার করেছেন’।

আসলে স্বামীজি হিন্দু ধর্মের কোনরূপ সংস্কারের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, তা সে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন হোক কিংবা হোক জাতিভেদ প্রথার বিলোপসাধন। আমরা সেটা আরো ভাল করে বুঝতে পারব এই প্রবন্ধের পরবর্তী ‘সমাজ সংস্কারক নাকি প্রথার অচলায়তনে বন্দি বিবেকানন্দ ?’ অংশে। কিন্তু তার আগে সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের ভোগ বিলাস নেয়েও একটু জানা দরকার ।

‘সন্ন্যাসী’ বিবেকানন্দের ভোগ বিলাস

আর জিহ্বা লাম্পট্য................................................ ✍️

বিবেকানন্দ সমালোচক যুক্তিবাদী নিরঞ্জন ধর ‘বিবেকানন্দ: অন্য চোখে’ গ্রন্থে বিবেকানন্দের সন্ন্যাস গ্রহণ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন- ‘বিবেকানন্দ স্বভাব সন্ন্যাসী ছিলেন না, ছিলেন অভাব সন্ন্যাসী’[৩১]। কথাটা ঠিকই । তার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি সন্ন্যাস জীবনের মাহাত্ম্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্ন্যাসী হননি, তিনি হয়েছিলেন অভাবের তাড়নায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একে বলতেন ‘পেট বৈরাগী’। সেজন্যই তার সন্ন্যাস জীবনের লেবাস ভেদ করে মাঝেমধ্যেই উঁকি দিতো উদগ্র লোভাতুর গৃহী রূপটিও। শুধু তার সন্ন্যাস গ্রহণ নয়, পরবর্তী কালে শিকাগো ভ্রমণ সহ যাবতীয় যশ খ্যাতি সবই ছিলো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মিলনের জন্য তৈরি বিবেকানন্দ এমনি এমনি রেডিমেড পয়দা হয়নি, নরেন্দ্রনাথকে বিবেকানন্দ বানিয়েছিলেন রাজস্থানের খেতরি মহারাজা অজিত সিংহ । সে সময়টা অখ্যাত এই নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দের আসল নাম) তখন পরিচিত ছিলেন ‘বিবিদিষানন্দ’ এবং ‘সচ্চিনানন্দ’ নামে। ১৮৯১ সালের জুন মাসে মাউন্ট আবুতে খেতরি রাজার সাথে আলাপ হয় এবং তিনি সেখানে ৬ মাস থেকে যান। খেতরি রাজার কোন পুত্র ছিল না। স্বামীজি ‘হুজুর সাইদাবাদী’ মার্কা কিছু পানি পড়া দিলেন (ডিটেল না হয় নাই বা বললাম) মনে হয় সেখানে, ফলে মহারাজা এক পুত্রসন্তান লাভ করলেন। পুত্র দেখতে শুনতে বিবেকানন্দর মতো হয়েছিলো কীনা তা আমার জানা নেই, কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় এর পর থেকেই মহারাজার সাথে বিবেকানন্দের এক ‘স্পেশাল’ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৮৯৩ সালে শিকাগো যাত্রার আগে আবার তিনি সেখানে যান। মহারাজা তাকে ৩০০০ টাকা দেন যাত্রার খরচ বাবদ; শুধু তাই নয় যে পোশাক পরা বিবেকানন্দের ছবি দেখে আমরা অভ্যস্ত, সেই পোশাকও তাকে দিয়েছিলেন অজিত সিংহ, দেখিয়ে দেন কিভাবে এই পোশাক পরতে হয়। সেই সাথে তার নতুন নামকরণ করেন ‘বিবেকানন্দ’ [৩২] !

এই অজিত সিং এর সাথে স্বামীজির সম্পর্ক এতোটাই ‘স্পেশাল’ ছিলো যে, সেটাকে বিবেকানন্দ নিজের পরিবারের স্বার্থে কাজে লাগাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণের আগে তিনি মা এবং ভাইদের ভরণপোষণের জন্য তিনি মহারাজকে দিয়ে একশত টাকার এক মাসিক ভাতা মঞ্জুর করতে রাজি করেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন নরেন্দ্রনাথের মা ভুবনেশ্বরী দেবী বেঁচে ছিলেন) নিয়মিত এই টাকা দিয়ে এসেছেন অজিত সিংহ। শুধু তাই নয় ১৮৯৮ সালে আবার স্বামীজির অনুরোধে মহারাজ স্বামীজির ব্যক্তিগত খরচের জন্য তাঁকে আরো একশ টাকা ভাতা মঞ্জুর করেন ।

তিনি বরাবরই এ ধরণের দেশীয় রাজা-মহারাজদের আথিত্য গ্রহণে অতিশয় ঔৎসুক্য দেখিয়েছেন। তিনি সুযোগ পেলেই রাজাদের রাজপ্রাসাদে বাস করতেন, রাজাদের সাথে খানাপিনা করতেন। বিদেশ থেকে ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর বিবেকানন্দের সম্মাননার আয়োজন করেন রামনাদের রাজা, মহীশুরের মহারাজা এবং পোরবন্দরের দেওয়ান। ভারত ভ্রমণে বেড়িয়েও তিনি অধিকাংশ সময় রাজ রাজড়াদের বাসস্থানেই উঠতেন। এ প্রসঙ্গে নিরঞ্জন ধর লিখেছেন –

‘… উক্ত রাজ্যসমূহের প্রায় সর্বত্রই বিবেকানন্দ তাঁদের রাজা বা রাজ্যের দেওয়ানদের আতিথ্য নিতেন এবং সেই রাজ্য ছেড়ে যাবার সময় নৃপতি বা দেওয়ানদের আতিথ্য নিতেন এবং সেই রাজ্য ছেড়ে যাবার সময় নৃপতি বা দেওয়ানদের কাছ থেকে পরবর্তী উদ্দিষ্ট শাসক, দেওয়ান বা উচ্চ-কর্মচারীর নামে পরিচয়পত্র নিয়ে যাত্রা করতেন। সন্ন্যাস জীবনের যে সর্বজন স্বীকৃত আদর্শ, তার সঙ্গে রাজা-গজাদের আতিথ্যের জন্য এতোখানি লালায়িত হওয়ার সামঞ্জস্য পাওয়া দুষ্কর’।

রাজ রাজড়াদের সাথে ‘সন্ন্যাসী’ স্বামীজির অন্তরঙ্গতা স্বামীজীর জীবদ্দশাতেই গৃহী গুরুভাইদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। দেশের বিত্তশালী অংশের সাথে বিবেকানন্দের এতটা মাখামাখি রামকৃষ্ণভক্তরা সুনজরে দেখেনি। তারা মনে করেছিলেন যে, স্বামীজি রামকৃষ্ণের আদর্শ লঙ্ঘন করেছেন। ১৮৯৯ সালে সাধারণ সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের ব্যাপারটা এতো প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, তারা বেলুড় মঠের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘গরীব রামকৃষ্ণ সভা’ নামে আলাদা সংস্থা সৃষ্টি করে ফেলতে শুরু করেছিলেন। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন গিরীন্দ্র ও হারাধন [৩৩]।

তবে শেষ পর্যন্ত নানামুখি মধ্যস্থতায় তাঁদের অসন্তোষ দূর করা হলেও এটি আমাদের কাছে বিবেকানন্দের ভোগবাদী চরিত্রের একটি দৃষ্টান্ত হয়েই রইবে ।

স্বামীজির ভোগবাদী চরিত্র বোঝার জন্য একটা নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না । পুনা থেকে স্বামীজি একবার ভাবনগরের মহারাজার পরিচয়পত্র নিয়ে কোলাহপুরে গিয়েছিলেন এবং কোলাহপুরের রানির প্রাইভেট সেক্রেটারি স্বামীজিকে বেলগাঁওয়ের এক মহারাষ্ট্রীয় ভদ্রলোকের কাছে একটি পরিচয়পত্র দেন। সেই পরিচয়পত্র নিয়ে স্বামীজি একদিন ওই ভদ্রলোকের বাসায় যান। ভদ্রলোকের বাসায় হঠাৎ হাজির হলেন, গল্প গুজব করলেন, তারপর ভুঁড়ি-ভোজ সম্পন্ন করার পরে স্বামীজি আয়েশ করে পান-সুপুরি চেয়ে বসলেন। তারপর চাইলেন দোক্তা। স্বামীজির ব্যাপার-স্যাপার দেখে গৃহকর্তার সুশিক্ষিত পুত্র মন্তব্য করলেন [৩৪] :

‘যে সন্ন্যাসীর এই এই প্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈহিক ভোগের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া উচিৎ, তাঁর মুখে এই জাতীয় চাহিদা শুনলে মনে কী ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হয় তা সহজেই অনুমেয়। … সন্ন্যাসী হয়েও তিনি এমন সব জিনিসের জন্য লালায়িত যা শুধু গৃহস্থদের বেলা শোভা পায়’।

খানাপিনা আর ভোগ-বিলাসের দিকে স্বামীজির এই দুর্বলতাগুলো শুধু ভারতে নয়, পশ্চিমেও নানা ভ্রু-কুঞ্চনের কারণ ঘটিয়েছিল। ১৮৯৪ সালে আলা-সিঙ্গাকে বিবেকানন্দ একটি পত্রে লিখেছেন –

‘কিছু একটা করে দেখাও । মাদ্রাজে আমার জন্য একটা গৃহ নির্মাণ করতে না পার তো আমি থাকবো কোথায় ?’

আবার আমেরিকায় থাকাকালীন অবস্থায় ইসাবেলকে লিখছেন,

‘গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটা মীরশ্যাম পাইপ কিনেছি। ফাদার পোপকে যেন আবার বোল না। কোটের দাম পড়বে ৩০ ডলার। আমি তো বেশ ভালই আছি। খাবার দাবার জুটছে, যথেষ্ট টাকা কড়িও। আগামী বক্তৃতাগুলো হয়ে গেলে ব্যাঙ্কে কিছু রাখতে পারব আশা করি’।

শিকাগো মহাসভার পরের দিনগুলোতে পাশ্চাত্যের মহনীয় বিলাস ব্যসনে এতটাই আপ্লুত হয়ে যান যে, তিনি ভারতে ফিরতেও দ্বিধান্বিত ছিলেন । ১৮৯৩ সালে আলা-সিঙ্গাকে লেখেন –

‘ভারতে গিয়ে ফল কি? ভারত আমার আইডিয়া শক্তিশালী করতে পারবে না। আমার আইডিয়ার প্রতি এদেশের (আমেরিকার) মানুষ সহৃদয়।‘

তার বোনকে ১৮৯৬ সালে লেখেন –

‘আমার হৃদয় রয়েছে আমেরিকায় । আমি ভালবাসি ইয়াঙ্কি দেশকে’।

তা ‘ইয়াঙ্কি দেশকে’ তিনি ভালবাসবেন নাইবা কেন, ভারতের হিন্দু ভিখারিরা তো আর তার রোজকার চুরুটের দামও দিতে পারবেন না, সেখানে তিনি পারবেন না ১৩ ডলার দিয়ে মীরশ্যাম পাইপ কিনতে বা ৩০ ডলার দিয়ে কোট কিনতে। বলা বাহুল্য, আজকের দুর্দিনের বাজারেও শিকাগোর কাপড়ের দোকানে সেল দিলে এখনো চল্লিশ ডলারের মধ্যেই থ্রি-পিস স্যুট দিব্বি পাওয়া যায়, সাথে টাই ফ্রি। আর ‘সন্ন্যাসী’ বিবেকানন্দ সে সময়ে বসে একটা পাইপের জন্যই খরচ করছেন ১৩ ডলার, আর একটা কোট কিনেছেন ৩০ দলার দিয়ে ।

এমনকি স্বামীজির বেহিসেবী খরচ আর অমিতব্যায়িতা দেখে আমেরিকার বহু ভক্ত তার সান্নিধ্য ত্যাগ করেছিলেন। বিবেকানন্দ স্তাবকদের বদান্যতায় আমরা অবশ্য কেবল আইরিশ নারী মিস মার্গারেট নোবলের নামই জানি, যিনি শিষ্য হিসেবে ভারতে এসে ভগ্নি নিবেদিতা নামে পরিচিত হন। কিন্তু একই সময় আবার অগণিত শিষ্য যে স্বামীজির অসন্ন্যাসীমার্কা কার্যকলাপের পরিচয় পেয়ে তার থেকে দূরে সরে গেছেন সে ব্যাপারটি চেপে যাওয়া হয়েছে নিপুণ কৌশলে। এপ্রসঙ্গে এডওয়ার্ড স্টার্ডির কথা বলা যেতে পারে, যার সাথে স্বামীজির পরিচয় হয়েছিল ইংল্যান্ডে। স্টার্ডি ইংল্যান্ডে স্বামীজির কাজের পরিচালকও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে তিনি জানালেন যে, স্বামীজি মধ্যে তিনি ‘মহত্তম বন্ধু ও বিশুদ্ধ গুরুর’ সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু পরের বছরের শুরুতেই স্বামীজির স্বরূপ পুরোপুরি বুঝবার পর তার সম্বন্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখি। তিনি স্বামীজির অন্ধভক্ত সিস্টার নিবেদিতাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন –

‘এই দেশে যে সব সন্ন্যাসীর পদার্পণ ঘটেছে তাঁদের বৈরাগ্য সম্পর্কে অনেক কিছু শোনা গেলেও আমি তাঁদের মধ্যে বৈরাগ্যের অতি সামান্য পরিচয়ই পেয়েছি। আমি কোনভাবে আপনার আদর্শকে প্রভাবিত করতে চাই না, তবে স্বীকার করতেই হবে যে, নানাভাবে আমি তার সম্পর্কে নিরাশ হয়েছি’।

আরেকটি চিঠিতে স্টার্ডি বলেন,

‘এই দেশে আমি সন্ন্যাসের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু মুখে যারা এ-বিশয়ে সোচ্চার, তাঁদের ব্যবহারে আমি এর কোন নিদর্শন পাইনি। … আহার ও বাসস্থান নিয়ে তাঁরা সর্বদা অসন্তোষ জানাচ্ছেন। বস্তুত এই সব তথাকথিত সন্ন্যাসীদের পুষতে আমাদের দারিদ্র্য-পীড়িত কেন্দ্রগুলির যে ব্যয় বহন করতে হচ্ছে তা একজন পরিশ্রমী অধ্যক্ষ, তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক কিংবা একজন ডাক্তারের ভরণ-পোষণের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি, যদিও তারা ত্যাগী বলে নিজেদের জাহির করেন না। … আমি শুধু বলতে চাই যে, আমি কোথাও উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা দেখার আশা রাখি না, বা দেখতেও চাই না, তবে কোন ছলনা বা মিথ্যাচারকেও স্বীকার করতে রাজি নই। যদি সন্ন্যাসীর মধ্যে আমরা মানসিক সন্তোষ ও স্থৈর্য, সরল পরিবেশের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি না দেখি এবং তার পরিবর্তে যদি তারা শিলং-মূল্যের চুরুট, সর্বোৎকৃষ্ট আহার ও বেশভূষার জন্য কেবলই দাবী জানাতে থাকেন তাহলে তাঁদের স্বরূপ সম্পর্কে আমরা কী ধারণা করতে পারি? আমি শুধু বলতে পারি যে, তাঁদের জীবনে সন্ন্যাসের আদর্শ প্রতিফলিত হয়নি’।

স্টার্ডির এই অভিযোগ নিবেদিতাকে খুব বেকায়দায় ফেলেছিল। তিনি সে সময় আমতা আমতা করে কিছু জবাব দিলেও তার পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি যে, রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা ‘যথেষ্ট আত্মসংযমী নন’। শুধু স্টার্ডি নয়, স্বামীজির বেহুদা বেপরোয়া খরচ আর ভোগ বিলাস দেখে তিতি বিরক্ত হয়ে স্বামীজির সংস্রব ত্যাগ করেন একদা অনুরক্ত হেনরিয়েটা মুল্যারও। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি ভারতের জনগণের সেবার জন্য স্বামীজিকে যে অর্থ দিয়েছিলেন তা বিবেকানন্দ পারিবারিক প্রয়োজনে এবং বেলুড় মঠে নিজে থাকার জন্য বড় বড় তিনটি আরামপ্রদ ঘর (নিরঞ্জন ধর একে বিবেকানন্দের বাগানবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেছেন) তৈরিতে ব্যয় করেছেন। লুই বার্কের ‘সেকেন্ড ভিজিট’ গ্রন্থে স্বামীজির ভোগবিলাস এবং জিহ্বা লাম্পট্যের অনেক উদাহরণ সংকলিত হয়েছে [৩৫]।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শিকাগো মহাসভার সম্মিলনের সময় এবং তার পরবর্তী বছরের সময়গুলোতে সমগ্র ভারতবর্ষে চলছিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ১৮৯৬-৯৭ সালে রাজস্থান, বর্তমান উত্তরপ্রদেশ, বোম্বাই, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ বিশেষত মধ্যপ্রদেশে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের সংখ্যা ছিলো ৯৬.৯ লক্ষ এবং দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ছিলো ৫১.৫ লক্ষ। অথচ ‘জীব-প্রেমিক’ বিবেকানন্দ মধ্যভারতের দুর্ভিক্ষের সময় প্রপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য একটি কপর্দকও সাহায্য দিতে রাজী হননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, তিনি কিন্তু স্বদেশ তার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে প্রচুর অর্থব্যয় করতে শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন আমেরিকা থেকেই। তখনো দেশে দুর্ভিক্ষ পুরোদমে চলছিলো। অভ্যর্থনা বাদ দিয়ে কিংবা সংক্ষেপিত করে সেই অর্থ তিনি দুঃস্থ মানুষের সাহায্যে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং, তার বন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছেন [৩৬],

হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করেছিলাম যে আমায় নিয়ে একটা হৈ চৈ হয়। কি জানিস, একটা হৈ চৈ না হলে তাঁর (ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের) নামে লোক চেতবে কি করে ! … তাকে ঠিক জানলে তবে ঠিক মানুষ তৈরি হবে; আর মানুষ তৈরি হলে দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি তাড়ানো কতক্ষণের কথা !

বিবেকানন্দের স্বজাত্যবোধের উৎস কি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নাকি অন্ধ হিন্দুত্ব ?

লাগাতার প্রচারণার মাধ্যমে বিবেকানন্দকে খুব ঘটা করে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদী’ ব্যক্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে, তাকে দেয়া হয়েছে ‘দেশ নায়ক’ উপাধি। অথচ বিবেকানন্দের স্বজাত্যবোধের উৎস কখনোই ভারতীয়তা ছিলো না, ছিল হিন্দুত্ব। এ প্রসঙ্গে তার নিজস্ব উক্তিই ছিলো – ‘হিন্দু জাতি সমগ্র জগত জয় করিবে’ [৩৭]।

দেশ যখন দুর্ভিক্ষে তোলপাড়, বিবেকানন্দ তখন খেতরির মহারাজার কাছ থেকে প্রভূত অর্থ যোগাড় করে শিকাগো ধর্মসভায় যোগ দেন, এবং সেটাও হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্যই। রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথের’ দেখাদেখি তিনিও মুখে ‘সব ধর্মই সত্য’ টাইপের গৎবাঁধা বুলি মাঝে সাঝে প্রচার করলেও তিনি মূলত বেদান্ত দর্শনকেই মহাসত্য মনে করতেন। তিনি সেজন্যই বলতেন, ‘বেদান্ত – কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোন ধর্মই নয়’ [৩৮]।

এমনকি জগতের অন্য সব জাতি অপেক্ষা হিন্দুদেরই তিনি অধিক নীতি-পরায়ণ জাতি বলে মনে করতেন [৩৯]।

স্বামীজি ভারতবর্ষ বলতে কেবল হিন্দুদের ভারতবর্ষই বুঝতেন। তিনি যে ভারতবর্ষে কেবল হিন্দুদেরই একাধিপত্য চাইতেন তা মাদ্রাজে তার মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা দেখেই বোঝা যায়। তিনি বলেন [৪০],

‘আমরা যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কথা বলিতেছি উহা অসাম্প্রদায়িক হইবে, উহাতে সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ উপাস্য ওঙ্কারেরই কেবল উপাসনা হইবে। যদি কোন সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপসনায় আপত্তি থাকে, তবে তাহার নিজেকে হিন্দু বলিবার অধিকার নাই।‘

এখন বহু জাতি এবং ধর্মের দেশ ভারতে যে ‘ওঙ্কার’ চিহ্ন কখনোই সকলের একমাত্র উপাস্য হতে পারে না, সেটা বিবেকানন্দ বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন। তিনি হিন্দুধর্মের ওঙ্কারোপসনাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে আবার সেটাকে নাম দিয়েছেন ‘অসাম্প্রদায়িক মন্দির’। এই দ্বিচারিতার কোন সীমা-পরিসীমা নেই ।

স্বামীজি খেতরির মহারাজের বদান্যতায় শিকাগো মহাসভায় যোগ দেন হিন্দু ‘গৈরিক বসন’ পরে সেটা আমরা আগেই জেনেছি। সেখানে জনৈক ভক্তকে আশা প্রকাশ করে লেখেন, ‘প্রভুর ইচ্ছা হলে এখানে (আমেরিকা) ও ইংল্যাণ্ডে গৈরিক পরিহিত সন্ন্যাসীতে ছেয়ে যাবে’ [৪১]।

কখনো কখনো স্বামীজির হিন্দু ধর্মপ্রেম রূপ নিতো উদগ্র সাম্প্রদায়িকতাতেও । তার বহু উক্তি এবং লেখায় এর প্রতিফলন আছে। হিন্দুদের পরধর্মসহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন, পাশাপাশি আবার মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের ‘পরধর্মবিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন [৪২]।

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মকে বিষাক্ত জীবাণুর সাথে তুলনা করে তিনি বলেন [৪৩],

‘পাপ দুষিত খাদ্য ও নানাবিধ অনিয়মের দ্বারা (হিন্দুদের) দেহ পূর্ব হইতেই যদি দুর্বল না হইয়া থাকে, তবে কোন প্রকার জীবাণু মনুষ্যদেহ আক্রমণ করিতে পারে না’।

তিনি প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে ‘বেশ্যাবৃত্তির’ সাথে তুলনা করে তিরস্কার করেছেন [৪৪],

হিন্দু সমাজত্যাগী মুসলিমদের স্বামীজি ‘দেশের শত্রু’ বলেও চিহ্নিত করেন [৪৫] –

‘কোন লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়। একটি করে শত্রু বৃদ্ধি হয়’ ।

তিনি হিন্দু সমাজককে মুসলিমদের সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন [৪৬], –

এইটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, মুসলমানগণ যখন ভারতে প্রথম আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল, আজ তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে ।

শুধু ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের উপর ঝাল ঝেড়েই স্বামীজি ক্ষান্ত হননি, হিন্দু ধর্মের যাবতীয় কুসংস্কারের দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন বৌদ্ধধর্মের উপরে । তিনি বলেন [৪৭],

আমাদের সমাজে যে সকল বিশেষ দোষ রহিয়াছে, সেইগুলি বৌদ্ধধর্মজাত। বৌদ্ধধর্মই আমাদিগকে তাহার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতির ভাগী করিয়াছে ।

ভারত যে হিন্দু-প্রধান দেশ, এবং দেশটা মূলতঃ সেজন্য হিন্দুদের জন্যই – সেটা সবসময় বিবেকানন্দ মাথায় রাখতে চেয়েছেন। হিন্দু ধর্মের এই জল হাওয়া কারো অপছন্দ হলে তাকে ‘মানে মানে সরে পড়বার’ উপদেশ দিয়ে বিবেকানন্দ বলেন [৪৮],

‘এ দেশে সেই বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালি পাঁঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হওয়, সরে পড় না কেন’।

সমাজ সংস্কারক নাকি প্রথার অচলায়তনে বন্দি বিবেকানন্দ ?

বিবেকানন্দকে সমাজ সংস্কারকের তকমা লাগিয়ে মিডিয়ায় তুলে ধরা হলেও তিনি আসলে যে বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন, আর সেই সাথে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ সহ অনেক কুৎসিত প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন, তার বেশকিছু দৃষ্টান্ত আমরা উপরে দেখেছি। তিনি প্রথাবিরোধী কেউ ছিলেন না, বরং প্রথার সুচতুর রক্ষক। এটার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথার অচলায়তনে বন্দি বিবেকানন্দের নিজস্ব স্বীকারোক্তি থেকেই [৪৯] –

‘যতোই বয়োবৃদ্ধি হইতেছে, ততই এই প্রাচীন প্রথাগুলি আমার ভালো বলিয়া মনে হইতেছে’।

তিনি সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি এতোই মোহাবিষ্ট ছিলেন যে, সংস্কারের প্রয়োজনে পাছে ধর্মে আঘাত লাগে, তাই ‘সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়’ বলে নিশ্চেষ্ট থাকতে চেয়েছেন[৫০]।

তার ব্রাহ্মণ শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন, ‘তুই বামুন, অপর জাতের অন্ন নাই খেলি’ [৫১]।

জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে এর চেয়েও স্পষ্ট উক্তি আছে স্বামীজির। তাঁর মতে [৫২],

‘জাতিভেদ আছে বলেই ত্রিশ কোটি মানুষ এখনো খাবার জন্য এক টুকরো রুটি পাচ্ছে’।

তিনি এও বলেছেন, ‘জাতিপ্রথায় উচ্চতা অর্থ দ্বারা নিরূপিত হয় না’। এমনকি জাতিভেদকে সমাজতন্ত্রের সাথেও তুলনা করে বলেছেন- জাতিপ্রথা এক ধরণের সমাজতন্ত্র, কেননা ‘জাতির মধ্যে প্রত্যেকেই সমান’ [৫৩]।

এ প্রসঙ্গে নিরঞ্জন ধর তার ‘বিবেকানন্দ অন্য চোখে’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন –

স্বামীজি কেবল জাতিপ্রথাকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হননি, এমনকি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তিনি তাঁদের বর্তমান হীন সামাজিক অবস্থাকে মেনে নিতেও পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন, ইন্দুমতী নাম্মি এক পত্রলেখিকাকে তিনি জানাচ্ছেন, ‘ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ‘দেব দেবী’ লিখিবে, বৈশ্য ও শূদ্রেরা ‘দাস’ ও দাসী’। এমনকি বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়, কারণ তিনি লিখেছেন, ‘জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে । ’

সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রসঙ্গেও আসা যাক । বিবেকানন্দকে পরিচিতি দেয়া হয়েছে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত তুখোড় ছাত্র এবং পরবর্তীতে বিশাল শিক্ষাবিদ হিসেবেও। কিন্তু তার এন্ট্রান্স, এফএ এবং বিএ পরীক্ষার মার্কশিটের হাল দেখলে কিন্তু তা মনে হবে না। ইংরেজি ভাষায় তিনি আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড  জয় করেছেন বলে তার ভক্তরা হৈ-হুল্লোড় করেন, অথচ ইংরেজিতে তাঁর নম্বর এন্ট্রান্সে ছিলো  ৪৭, এফএ-তে ৪৬ এবং বিএ-তে ৫৬।  অঙ্ক, ইতিহাস প্রভৃতিতেও ফলাফল আশানুরূপ নয়। ত্রিশ চল্লিশ বড়জোর পঞ্চাশের ঘরে পেয়েছেন নম্বর বিষয়গুলোতে। লজিকে তো পেয়েছিলেন মাত্র ১৭।

অবশ্য বিবেকানন্দের মার্কশিটের ব্যাপারটা এখানে উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে জোর করে থাকে খারাপ প্রমাণ করা। কারণ আমরা জানি অনেক খারাপ ছাত্রই পরবর্তী জীবনে পেশাগত সাফল্য পেয়েছেন। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ কিংবা অধুনা বিল গেটস, স্টিভ জবস সহ অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েও কিংবা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করেও  স্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন নিজের কাজের গুণেই তা আমরা দেখেছি। বিবেকানন্দও কিন্তু তেমনি।  তার শিক্ষা জীবন পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ডের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি মোটেই। তিনি তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন নিজ গুণেই। কিন্তু মার্কশিটের ব্যাপারটা উল্লেখ করা হোল এ জন্যই যে ভাবালুতা এড়িয়ে ভাবতে শেখা যে, বিবেকানন্দ কোন উঁচুমানের কৃতবিদ্য ছাত্র ছিলেন না, বরং ছিলেন আর দশজনের মতো অতি সাধারণ মানেরই ।

শিক্ষায়তনের মার্কশিটের কথা না হয় বাদ দেই, ভারতবর্ষে যে শিক্ষার উন্নতির চেষ্টার জন্য বিবেকানন্দকে এতো উচ্চাসনে বসানো হয়, সেই শিক্ষা নিয়েই বা তার ভাবনা কেমন ছিলো? বিবেকানন্দ শিক্ষার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তার সে শিক্ষার ব্যাপারটা পুরোটাই তার হিন্দু ধর্মকে সামনে রেখে। বেদান্ত আর আনুষঙ্গিক হিন্দুধর্মের জ্ঞান ছাড়া অন্য কোন কিছুর দরকার নেই, সেটা তিনি স্পষ্ট করেছেন এই উদ্ধৃতিতে –

‘যত কম পড়বে তত মঙ্গল। গীতা ও বেদান্তের উপর যে সব ভাল গ্রন্থ আছে সেগুলি পড়। কেবল এগুলি হলেই চলবে ।‘

যত কম পড়বে ততই ভাল, কিংবা কেবল হিন্দু বই-পুস্তক ছাড়া অন্য সব কিছু পরিত্যাজ্য, এটা বিবেকানন্দ শিক্ষাদর্শনের সার কথা। তারপরেও বিবেকানন্দের ভক্তরা তার শিক্ষাদর্শন নিয়ে নিদারুণ গর্বিত থাকেন। হ্যাঁ শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে বিবেকানন্দের কিছু ভাল ভাল কথা আছে বটে, কিন্তু এর বিপরীতটাও কম দৃশ্যমান নয়। দুই একটি উদাহরণ দেয়া যাক –

‘বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হওয় না’ [৫৪]।

কিংবা এটি –

‘ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থাদি ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন ততই ভাল [৫৫]।

তবে গ্রন্থ সম্বন্ধে বিবেকানন্দের এই উক্তিটিই ক্লাসিক –

গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকর মতবাদ দেখা যায়, সেগুলোর জন্য এই সকল গ্রন্থই দায়ী [৫৬]।

যার বই-পুস্তক গ্রন্থাদির প্রতি এত বিরাগ তাকে কি করে একজন শিক্ষা-সচেতন আদর্শ ব্যক্তি বানিয়ে স্তব করা যায়, তা কোনক্রমেই আমার বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দীক্ষাকে তিনি ‘কেরানি গড়ার কল’ বলে ব্যঙ্গ করতেন, উচ্চশিক্ষা উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন,

‘একদিক থেকে দেখলে তদের বড়লাটের উপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। High education (উচ্চ শিক্ষা ) তুলে দিচ্ছে বলে দেশটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে।‘

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির রাজা যেমন বলতেন, ‘জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’ , বিবেকানন্দও একই ধরণের উপদেশ বর্ষণ করেছেন পাশ্চাত্য দেশবাসীদের জন্য [৫৭] –

যতটা জানিলে তোমার পক্ষে কল্যাণ তোমরা তাহা অপেক্ষা বেশি জান – ইহাই তোমাদের মুশকিল ।

ব্রিটিশ-বিরোধী বিবেকানন্দ, নাকি ব্রিটিশের একনিষ্ঠ স্তাবক ?

স্বামীজির ব্রিটিশ বিরোধিতা নিয়েও প্রচুর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে ভক্তদের তরফ থেকে। তার বহু ভাষণ, বানী উদ্ধৃতি সামনে নিয়ে এসে বিবেকানন্দ ভক্তরা প্রমাণ করতে চান যে, বিবেকানন্দ ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য একেবারে যেন ঝাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন! তিনি ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য তরুণদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, এমনকি বন্ধুক নির্মাতা ম্যাক্সিম হিরণের সঙ্গে নাকি বন্ধুত্ব করেছিলেন। তিনি নাকি মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশ থেকে অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে এসে সেহ স্বাধীন করার পায়তারা করছিলেন। কিন্তু এ সমস্ত ঘটনা বেশিরভাগই অতিরঞ্জন কিংবা বিবেকানন্দের খণ্ডিত চিত্র। হ্যাঁ বিবেকানন্দের অনেক বানীই আছে যা উপর থেকে দেখলে ‘ব্রিটিশ বিরোধিতার’ মত শোনাবে বটে, কিন্তু একটু গভীরে ঢুকলেই পাওয়া যায় তার চিরন্তন স্ববিরোধী চরিত্রের হদিসটি। যেমন, প্রাসঙ্গিক-ভাবে একটি ঘটনার কথা বলা যায়। শিকাগো মহাসভা থেকে ফেরার পর কলকাতায় এক অভিনন্দন সমাবেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিবেকানন্দ আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন, “ইংরাজদের সম্বন্ধে যে ঘৃণার হৃদয় নিয়ে আমি ইংলণ্ডের মাটিতে পদার্পন করেছিলাম, কোন জাতি সম্বন্ধে তার থেকে অধিক ঘৃণার ভাব লয়ে সে দেশের মাটিতে আর কেউ কখনো নামেনি।” বিবেকানন্দভক্তরা বিবেকানন্দের এই বক্তব্যকে তুলে ধরে প্রমাণ করতে চান এটি তার ইংরেজ-বিরোধিতার নমুনা। কিন্তু আসলে এটা বিবেকানন্দের বক্তব্যের খণ্ডিতাংশ। “কেউ কখনো নামেনি”-র পরের লাইনেই বিবেকানন্দই কিন্তু বলেছিলেন, “এই সভা মঞ্চে যেসব ইংরেজ বন্ধু উপস্থিত আছেন, তারাই সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু যতই আমি তাদের মধ্যে বাস করতে লাগলাম, তাদের জাতীয় জীবনযন্ত্র কিভাবে কাজ করছে দেখতে পেলাম, তাদের সঙ্গে মিশে জানলাম কোথায় রয়েছে তাদের জাতির হৃৎস্পন্দন – ততই আমি তাদের ভালবাসতে লাগলাম। তার ফলে, হে ভাতৃগণ, এখানে এমন কেউ নেই যিনি আমার থেকে ইংরাজদের বেশি ভালবাসেন।”[৫৮]

বিবেকানন্দ তার বহু লেখাতেই ইংরেজদের অভিহিত করেছেন ‘বীরের জাতি’,’ প্রকৃত ক্ষত্রিয়’, ‘অটল ও অকপট’, এবং ‘প্রভু’ হিসেবে [৫৯]।

কীভাবে ‘বীর্য, অধ্যবসায় ও সহানুভূতির’ সাথে শাসন করলে ভারতে ‘শতবার’ ইংরেজ শাসন বজায় থাকবে, তার ফিরিস্তি দিয়েছেন [৬০]।

বিবেকানন্দ যে ছিলেন চরম ও পরম ইংরেজভক্ত, সেটা নিজেই লেখায় উল্লেখ করেছেন [৬১]।

ভক্তদের পক্ষ থেকে আজ তাকে অযথা ‘যুগনায়ক’, ‘মহাবিপ্লবী’ প্রভৃতি বানানোর চেষ্টা করা হলেও আসল কথা হল, স্বামীজি কখনোই ইংরেজ শাসনের সংগে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় যেতে চাননি। ব্রিটিশ শাসককে তোষামোদ করতে গিয়ে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধান্বিত হননি। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে বাতিল করে, এবং বিদ্রোহীদের ‘ডাকাত’ হিসেবে অভিহিত করে দিয়েছিলেন নিম্নোক্ত মন্তব্য [৬২] –

“সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে – ‘ইংরেজ আমাদের দাও।’ বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়াছে, তারের খবর দিয়াছে, রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়াছে, ডাকাতদের তাড়াইয়াছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়াছে। আবার কী দেবে ? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয় ? বলি তোরা কী দিয়েছিস ?”

এই উক্তি থেকে বোঝা যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের কোন স্পষ্ট ধারনা ছিলো না। হ্যাঁ, রেল ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রচলন, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ব্রিটিশরা করেছে, কিন্তু এগুলোও তারা করেছে তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার প্রয়োজনেই, ভারতের উন্নতি করার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, যা রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দেরা সে সময় ভাবতেন। ব্রিটিশেরা ভারতে এসে প্রথমেই যেটা করতে সফল হয়েছিল তা হচ্ছে দেশী শিল্পের ধ্বংস সাধন, এবং পাশাপাশি ব্রিটেন থেকে আসা দ্রব্যের একটা বড় সড় বাজার তৈরি। এই প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সে সময় অনুভব করে ইংরেজরা [৬৩]।

ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো শিল্পজাত নানা দ্রব্য ভারতের বন্দরগুলো থেকে দেশের অভ্যন্তরে বহন করে নিয়ে যাওয়া, ভারতের কাঁচামাল বন্দর পর্যন্ত পৌঁছানো, আর তার সাথে চলমান বিদ্রোহ বিপ্লবকে ঠাণ্ডা করে ভারতকে সামরিক শক্তির পদানত রাখার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ কম সময়ের মধ্যে সৈন্য সামন্ত প্রেরণের সুবিধার জন্য ভারতে রেলপথ স্থাপন খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। এমনকি লর্ড ডালহৌসির ১৮৫৩ সালের প্রতিবেদনেও ব্যাপারটা স্বীকার করে বলা হয়েছিল, রেলওয়ে স্থাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের কাঁচামাল সরবরাহের উৎস এবং অপরদিকে ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের রপ্তানিকৃত শিল্পদ্রব্যের বাজার হিসেবে গড়ে তোলার সুস্পষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে [৬৪]।

শুধু বিবেকানন্দ নন, তার সারা জীবনের অর্থের যোগানদাতা বন্ধু রাজা অজিত সিংহও ছিলেন এক পরম ব্রিটিশ অনুরক্ত শাসক। ১৮৯৭ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের হীরক জয়ন্তী উৎসব পালিত হয়েছিলো। সেই সময় ব্রিটিশ অনুরক্ত নৃপতিরা দলে দলে ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে আনুগত্যের শপথ জানিয়ে এসেছিলেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, মহারাজা অজিত সিংহও দলের সাথে মিলে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার স্তব করতে সেখানে গিয়েছিলেন ।

স্বামীজি- বহুরূপে সম্মুখে তোমার.......................... ✍️

আসলে পুরো স্বামীজিই আদ্যোপান্ত স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। বিবেকানন্দের যেমন অনেক বিপ্লবী এবং প্রগতিশীল উক্তি আছে, তেমনি আছে বহু কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং গোঁড়া উক্তি-ও। এটা আমার কথা নয়, রামকৃষ্ণ জিবনীকার ক্রিস্টোফার ইশারউডও সেটা স্বীকার করে বলেছেন [৬৫] –

‘স্বামীজি আজ যা বলতেন, পরদিন তার কথার সাথে কোন মিল থাকতো না ।‘

‘আজ যা বলতেন, পরদিন তার কথার সাথে কোন মিল থাকতো না’ – দুর্ভাগ্যক্রমে এইটাই স্বামীজির পরিপূর্ণরূপ। সেজন্য সচেতনভাবেই আমি এই প্রবন্ধের নামকরণ করেছি ‘স্ববিরোধী বিবেকানন্দ’। হ্যাঁ, বিবেকানন্দ জনসেবামূলক কাজ করেছেন, জীবপ্রেমের কথা বলেছেন, কিন্তু আবার অন্যমুখে যে পশুবলি দিয়ে উৎসাহিত হয়েছেন, সেটা আমরা প্রবন্ধের প্রথমেই দেখেছি। এমনকি আরেকটু গভীরে ঢুকলে দেখা যাবে, তার জনসেবামুলক কাজগুলোর প্রেরণাও নিঃস্বার্থ ছিলো না। মূলত জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমে দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের মাথার মধ্যে ‘হিন্দুধর্মের বীজ’ বপনই ছিলো তার সেবাপরায়ণতার মূল উদ্দেশ্য। তিনি জনসেবাকে অস্ত্র হিসেবে নিয়েছিলেন দরিদ্র মানুষের মগজ ধোলাই করে বিশ্বাসের কাতারে আনতে, সেটা তার অনেক কাজ এবং উক্তি থেকেই স্পষ্ট হয় । ১৮৯৭ সালে আলমোড়া থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত এক পত্রে স্বামীজি নির্দেশ দেন [৬৬] –

কলিকাতার মিটিং এর খরচা বাদে যা বাঁচে, তা ঐ famine তে পাঠাও বা কলিকাতা, ডোমপারা, হাড়িপারা বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাঁদের সাহায্য কর… ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাঁদের সাহায্য কর… ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর লোকের (হিন্দুত্বে) বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে ।

স্বামী অখণ্ডানন্দ মহুলাতে যখন গ্রামে গ্রামে গরীব ঘরে চাল বিতরণ করছিলেন, তখন স্বামীজি তার সমালোচনা করে বলেছিলেন – ‘চাল বিতরণে শক্তিখরচ করে কি হবে, যদি কোন প্রচারকার্যই না হয়’ [৬৭]।

তিনি একবার ‘প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকা’ নামে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যত হন, কারণ, তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের হিন্দু ধর্মের একই ছায়ার নীচে আনতে চেয়েছিলেন । তার নিজের কথাতেই,

‘প্রবুদ্ধ –শব্দটার মধ্যেই (প্র + বুদ্ধ) বুদ্ধের অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে ভারত জুড়লে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ হিন্দু ধর্মের সাথে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন বোঝাতে পারে। ঐ নামটা দিলে তাতে হিন্দুদের মনে কোন আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদেরও আমাদের দিকে আকৃষ্ট করবে’।

তার সামন্ত প্রভুদের স্বার্থ বজায় রাখতে বিবেকানন্দ সবসময় সচেতনভাবেই নানা স্ববিরোধী মন্তব্যের আশ্রয় নিয়েছেন । এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলির ২য় খণ্ডে বর্ণিত একটি ঘটনায়। গঙ্গা মহারাজা (স্বামী অখণ্ডানন্দ) তখন নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য খেতরি রাজ্যে গিয়েছিলেন। তখন বিবেকানন্দ তাকে একটি চিঠিতে গরীব এবং নিচু জাতির লোকজনের ঘরে গিয়ে ধর্মোপদেশ দিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু অখণ্ডানন্দ খেতরিতে এসে দেখলেন সেখানে অনেক নীচতলার অধিবাসীরা দাসসুলভ ব্যবহারে অতিষ্ঠ। তিনি তখন গোলাম বলে চিহ্নিত দাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলনে শরিক হয়ে যান। কিন্তু প্রজাপীড়ক রাজা অজিত সিংহও এতে যার পর নাই রুষ্ট হন। ঘটনা কালক্রমে বিবেকানন্দের কানে পৌঁছুলে তিনি অজিত সিংহের পক্ষ নিয়ে গঙ্গাকে ভর্ৎসনা করে বলেন -

‘গঙ্গা সন্ন্যাসী, তারা রাজা, তাঁদের রাজকর্মের পলিটিকসে হাত দিতে গেছলো কেন? এর জন্য তো রাজা অজিত সিং একটু বিরক্ত হয়েছিল’।

তাই একদিকে নিজের ‘প্রগতিশীল’ ইমেজ বজায় রাখতে ‘হে ভারত ভুলিও না…’ ধরণের জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন, তিনি আবার মুখ মুছে উপদেশ দিয়েছেন ‘ধনী-দরিদ্রের বিবাদ যেন বাঁধিয়ে বোস না; ধনীদের আদতে গালমন্দ দেবে না’ [৬৮]।

ডোম, মেথর, মুচিদের প্রতি কিংবা শূদ্রদের প্রতি তার জ্বালাময়ী ভাষণ, কিংবা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিও ছিলো আসলে তার কৌশলগত প্রচারণা। শূদ্র-ভারতের জাগরণের কথা বললেও একই মুখে আবার বলেছেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মণই মনুষ্যত্বের চরম আদর্শ’। তিনি এও বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণদের মধ্যেই অধিকতর মনুষ্যত্ব-বোধসম্পন্ন মানুষের জন্ম হয়’ [৬৯]।

শুদ্রদের নিয়ে তার সহানুভূতির খেলা যে কীরকম কৌশলী ছিলো তা বোঝা যায় ১৮৯৫ সালে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রদের সবাইকেই ‘খুশি করে চলার’ উপদেশ দিয়ে পত্রিকার সম্পাদককে বলেন –

‘গত সংখ্যায় ক্ষত্রিয়দের খুব বাড়ানো হয়েছে, পরের সংখ্যায় ব্রাহ্মণদের খুব প্রশংসা কর, তার পরের সংখ্যায় বৈশ্যদের’ [৭০]।

যুগনায়ক, দেশনায়ক কিংবা সন্ন্যাসী কোনটিই নয়, বরং ‘বহুরূপে সম্মুখে’ উঠে আসা এই কৌশলী বিবেকনন্দই ছিলেন প্রকৃত বিবেকানন্দ। তিনি সব ধর্মের সব সম্প্রদায়ের মানুষদের হিন্দু ধর্মের ছায়ার নিচে আনতে ‘যখন যেমন, তখন তেমন নীতি’ অনুসরণ করেছেন, কখনো সেজেছেন প্রগতিশীল, কখনো বা চরম রক্ষণশীলতার মুখোশ ব্যবহার করেছেন। নিজেকে প্রগতিবাদী প্রমাণ করতে কখনো শূদ্রদের নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন, কখনো বা পশ্চিমা নারীদের স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন, আবার যখন প্রয়োজন পড়েছে গোঁড়া রক্ষণশীলদের মতোই নারীদের নামে বক্রোক্তি করেছেন কিংবা জাতিভেদকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন। যখন পেরেছেন বিধবা বিয়েতে বাধা দিয়েছেন, এমনকি সমর্থন করেছেন সতীদাহের মত বর্বর প্রথাকেও।

স্বামীজির এই দ্বিচারী মনোভাবকে তুলে ধরার অর্থ এই নয়, তার ভাল ভাল কাজকে অস্বীকার করা। তার অসংখ্য ভাল কাজ আছে বলেই তিনি সমগ্র ভূ-ভারতে একজন আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু আমি চেয়েছি ভক্তদের ভক্তির ভাবালুতায় আপ্লুত হয়ে বিবেকানন্দের চারিদিকে যে স্বর্গীয় জোতির্বলয় (halo) তৈরি করা হয়েছে,তা থেকে স্বামী বিবকানন্দকে বের করে নিয়ে এসে মানুষ বিবেকানন্দকে অনুধাবন করতে। আমরা বরাবরই বলে এসেছি মুক্তমনা হওয়ার অর্থ কেবল ধর্মের সমালোচনা নয়, বরং মহাপুরুষদের অমহাপুরুষসুলভ বিভিন্ন কাজের আলোচনা কিংবা সমালোচনা করাটাও কিন্তু মুক্তমনাদের ‘ক্রিটিকাল থিংকিং’ এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। আহমদ শরীফ তার বইয়ে কাঙ্গাল হরিনাথের উপর ঠাকুর বাড়ির প্রবল আক্রোশের কথা সুনিপুণ শিল্পীর মতো তুলে ধরেছেন। প্রবীর ঘোষ তার অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থে অনুকূল চন্দ্র সহ ভারতবর্ষের সব সম্মানিত পুরুষদের অযৌক্তিক ধ্যান ধারনার উল্লেখ করেছেন। প্রয়াত মুক্তমনা লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স তার বইয়ে এবং প্রবন্ধে মাদার তেরেসার অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেছেন – কিভাবে তেরেসা কালোবাজারির সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন, কিভাবে তিনি দারিদ্র্য নিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছেন, কিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ, কণ্ডম ব্যাবহার প্রভৃতিতে বাঁধা দিয়েছেন তেরেসা, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে তার যৌক্তিক বিশ্লেষণে। এগুলোতে দোষের কিছু নেই; মহাপুরুষদের পূজার আসনে বসিয়ে নিরন্তর স্তব নয়, বরং তাঁদের কাজের নির্মোহ বিশ্লেষণই কেবল আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সেজন্যই ধর্মীয় সমালোচনার পাশাপাশি মুক্তমনা লেখকেরা আগে রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, বায়েজিদ বোস্তামী, সম্রাট অশোক সহ অনেকের কাজেরই নির্মোহ বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, সেগুলো রাখা আছে আমাদের সাইটের ‘নির্মোহ এবং সংশয়ী দৃষ্টি : মুক্তমনের আলোয়’ বিভাগে। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে আলোচনা সেই ধারাতেই নতুন সংযোজনমাত্র ।

তথ্যসূত্র :

[০১] অপার্থিব ইংরেজীতে একসময় এ প্রসংগগুলো নিয়ে একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন মুক্তমনায় ‘An Irreverent Look at Some of India’s Most Revered Figures’ শিরোনামে।

[০২] প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয়, লৌকিক, দে’জ পাবলিশিং, একাদশ মূদ্রণ, ১৯৯৮, পৃঃ ২১৭।

[০৩] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[০৪] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[০৫] মহেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির ঘটনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৯৬।

[০৬] ভারতীয় নারী, উদ্বোধন, পৃষ্ঠা ৯০

[০৭] গোলাম আহমাদ মোর্তজা, বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, পৃঃ ১৫৯

[০৮] স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২।

[০৯] স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১২।

[১০] এস মানুষ হও, ষষ্ঠ সংস্করণ, উদ্বোধন, পৃঃ ৮।

[১১] স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃঃ ১৮।

[১২] ভারতীয় নারী, উদ্বোধন, পৃঃ ১৫।

[১৩] শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৪

[১৪] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পৃঃ ১৩৫।

[১৫] সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, বিবেকানন্দ চরিত, উদ্বোধন, পৃঃ ৩০১।

[১৬] শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রী রাম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, ১৯৮৬-৮৭।

[১৭ ] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয় থেকে সংগৃগীত; উক্তিগুলো পাওয়া যাবে রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ: মুক্তমনের আলোয় বইয়েও (র‍্যাডিক্যাল, ২০০২)।

[১৮] রাজেশ দত্ত (সম্পাদনা), রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ: মুক্তমনের আলোয়, র‍্যাডিক্যাল, ২০০২।

[১৯] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ১৭৮।

[২০] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ৩৬০।

[২১] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, গুরুভাব পূর্বার্ধ, প্রথম অধ্যায়, উদ্বোধন, পৃঃ ১৩।

[২২] শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, সাধক ভাব, বিংশ অধ্যায়, উদ্বোধন, পৃঃ ১৭৫।

[২৩] রাজেশ দত্ত (সম্পাদনা), রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ: মুক্তমনের আলোয়, র‍্যাডিক্যাল, ২০০২।

[২৪] বিপ্লব পাল, স্বামী বিবেকানন্দ-একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ, মুক্তমনা।

[২৫] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[২৬] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১১৪-১১৫

[২৭] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩০

[২৮] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১০ম খণ্ড, পৃঃ ৩৯

[২৯] ভগ্নী নিবেদিতা, স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি, পৃঃ ১৮৩

[৩০] সুতপা বন্দোপাধ্যায়, গুরুজি ও স্বামীজি, দৈনিক আজকাল, এপ্রিল ৮, ১৯৯৪।

[৩১] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[৩২] রোমা রলাঁর মতে বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন বলেই তার নাম রাখা হয় বিবেকানন্দ।

[৩৩] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[৩৪] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[৩৫] Marie Louis Burke, Swami Vivekananda’s second visit to the west, Vedanta Press ।

[৩৬] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[৩৭] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৩১

[৩৮] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৫৪

[৩৯] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩৫৯

[৪০] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৪

[৪১] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং -২৭২, পৃঃ ৪৪৪

[৪২] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৯

[৪৩] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৩

[৪৪] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৩

[৪৫] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৪

[৪৬] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২৬২

[৪৭] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৮১

[৪৮] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১১৮

[৪৯] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২২

[৫০] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩১

[৫১] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৩৭

[৫২] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[৫৩] নিরঞ্জন ধর, বিবেকানন্দ: অন্য চোখে, উৎস মানুষ সংকলন

[৫৪] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৮৫

[৫৫] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৯৯

[৫৬] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১০৯

[৫৭] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৪৪

[৫৮] বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২

[৫৯] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৩০৭

[৬০] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৫

[৬১] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৬

[৬২] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ২৫৩

[৬৩] সুকোমল সেন, ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-২০০০), এনবিএ, ষষ্ঠ মূদ্রণ, ২০০৫

[৬৪] সুকোমল সেন, পূর্বোক্ত।

[৬৫] খ্রিস্টোফার ইশারউড, রামকৃষ্ণ ও তার শিষ্যগণ, পৃঃ ২৭৮

[৬৬] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ৩৬৩, পৃঃ ৫৭২

[৬৭] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ৩৬৫, পৃঃ ৫৭৫

[৬৮] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ৪৭৬, পৃঃ ৯৬

[৬৯] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৬।

[৭০] পত্রাবলী, উদ্বোধন, পত্র নং ২৩৯, পৃঃ ৩৯১-৯২


বিবর্তনবাদ খণ্ডন



সাধারণ জ্ঞান দ্বারা বিবর্তনবাদ খণ্ডন 

👉 বিবর্তনবাদ বলে যে পাখিদের ডানা পূর্বে ছিল না কিন্তু যখন পাখিরা নানান জন্তুর থেকে নিজেকে বাঁচার চেষ্টা করেছিল উড়ার চেষ্টা করেছিল তখন তাদের ডানা তৈরি হয়েছে। এই অনুযায়ী বলা যায় যে প্রথমে বনমনুষ্যও তো  জঙ্গলে জন্মেছিল তারাও তো বাঘ, সিংহ, ভাল্লুকদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল তো তাদের কেন পাখির মতো ডানার বিবর্তন হয়নি ? মানুষেরও তো ডানা থাকা উচিত ছিল ? 

বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নানান উদ্দেশ্যে সাপদের ধরা হয় এবং হত্যাও করা হয় তা সাপ কি নিজেকে রক্ষা করার চেস্টা করেনা ? আর যদি করেও থাকে তাহলে আজও কেন সাপের কোনো হাত পা তৈরি হয়নি, যাতে সাপ নিজেকে রক্ষা করতে পারে ? 

👉 বিশ্বের প্রায় ৯৮% মানুষ মাংস, মাছ আহার করে।  গরু, শুয়োর, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, মাছ আদিকে হত্যা করে ভক্ষণ করে, তা আজও কেন এই সমস্ত জীবের মধ্যে  কোনো বিবর্তন হলো না যাতে তারা আমাদের থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে ? তারাও তো নিজের জীবন কে বাঁচানোর চেষ্টা করে তবুও কেন বিবর্তন হলো না ? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বিবর্তনবাদিদের কাছে নেই। 

👉 বিবর্তনবাদ বলে যে যে জিনিসের ব্যবহার করা হয়না তা লুপ্ত হয়ে যায় যেমন মনুষ্যের লেজ লুপ্ত হয়েছে।। এখানে প্রশ্ন তৈরি হয় যে বাদর তার দিয়ে কি কাজ করে ? যদি বলো যে "বাদর লাফিয়ে বেড়ায় তাই তাদের লেজ আছে"। তো মনুষ্য কি লাফিয়ে বেড়ানো বন্ধ করেছে ? বাঁদরের চেয়েও মনুষ্য বেশি কাজ করে,  তো মনুষ্যের লেজ কেন লুপ্ত হলো ?

👉 বিরবর্তনবাদ বলে যে একসময় জিরাফের গলা এই কারণেই লম্বা হয়েছে যে একসময় মাটির ঘাস শুকে গিয়েছিল তখন জিরাফ গাছের পাতা খাওয়ার চেষ্টা করেছিল কাজেই তাদের গলা লম্বা হয়ে গেছে।। বিরবর্তনবাদের ছাগলামী কথনের মধ্যে অন্যতম হল এই কথন টি, এই মূর্খরা জিরাফের গলার কাহিনী কল্পনা করতে গিয়ে এইটা ভুলে যায় যে জঙ্গলে তো শুধু জিরাফ থাকেনা গরু, মহিষ, হরিণ আদি নানান জীব থাকে তারাও ঘাস খায়। তো ঘাস শুকে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র জিরাফের গলা লম্বা হল কেন গরু, মহিষ, হরিণ গণ্ডারের তো জিরাফের মতো গলা লম্বা হওয়া উচিত ছিল, তাহলে এদের গলা কেন লম্বা হয়নি ? আর কত বছর ধরে মাটির ঘাস শুকনো অবস্থায় ছিল ? কত বছর ধরে জিরাফের গলা লম্বা হয়েছিল ? জিরাফের গলা লম্বা না হওয়ার আগে সে কি খেয়ে বেঁচে ছিল ? উত্তর আছে ? 

 লক্ষ করে দেখবে যে ছাগলও মাঝে মাঝে সামনের দুটি পা উঁচু করে গাছের পাতা খায় তা আজ পর্যন্ত ছাগলের গলা জিরাফের মতো কেন লম্বা হলো না ? 

👉 বর্ষাকালে নানান পতঙ্গ আগুনের দিকে ছুটে যায় আর তাদের মৃত্যু হয় । তা আজ পর্যন্ত এই পতঙ্গ সমস্ত পতঙ্গ গুলোর জ্ঞানের বিবর্তন কেন হলো না ? উত্তর আছে ? 

👉 বিবর্তনবাদের সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো এই যে সমস্ত জীবের বিবর্তন হলো কিন্তু মনুষ্যের কাছে এসে থেমে গেল, আর মনুষ্যের আর কোনো ভাবেও বিবর্তন হচ্ছে না, এমন কেন ? 

বিবর্তনবাদ একটি মহান মিথ্যার তত্ত্ব যা পুরোই যুক্তিহীন, বিবর্তনবাদ কে বহু বিজ্ঞানী খণ্ডন করেছে তাদের মধ্যে একজন অন্যতম হল "স্যার রিচার্ড ওয়েন" যিনি এক বিখ্যাত জীবাশ্ম বিষয়ক বিজ্ঞানী ছিলেন । ইনি বিবর্তনবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, আজ আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে এই মূর্খতা পূর্ণ বিবর্তনবাদ কে ছোট থেকে বড় ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানো হয়, কিন্তু কোথাও পড়ানো হয়না যে এই বিবর্তনবাদ কে অনেক বিজ্ঞানী খণ্ডনও করেছে, এমন কেন ?

অর্থাৎ বলা যায় মিথ্যার ওপরেও এখন বিজ্ঞান চলছে ! এই সমস্ত নাস্তিক কথিত বিজ্ঞানীরা বুক ফুলে বলে যে ধার্মিকরা অন্ধবিশ্বাসী, যুক্তিহীন বিষয়কে বিশ্বাস করে, তা আজ বিবর্তনবাদের মতো মিথ্যা বিষয় কে মেনে চলা বিজ্ঞানী আর একটি অন্ধবিশ্বাসী কথিত ধর্মীকের পার্থক্য  থাকলো কোথায় ? একই অবস্থা ।




Thursday, August 27, 2020

গীতা জ্ঞান কৃষ্ণ পূর্বে সূর্য্যকে দিয়েছিলো

 


গীতা জ্ঞান নাকি শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে সূর্য্যকে দিয়েছেন , আর সূর্য্য তার পুত্র আদি পিতা মনুকে দিয়েছেন ও মনু তার পুত্র ইক্ষ্বাকুকে দিয়েছেন ?

গীতা ও মহাভারত অনুসারে কথাটা মিথ্যে নয় , আমাদের বোঝার ভুল আছে অনেক । কারণ কথাটা গীতা জ্ঞান হবে না , হবে কর্ম যোগ সম্পর্কিত জ্ঞান । যদি গীতার জ্ঞান এই কথা বলেন তাহলে আমাকে বলতে হবে যে মহাভারতের পূর্বেও পাণ্ডব আর কৌরবদের মধ্যে আরো একবার বা একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে , কিন্তু কিন্তু প্রকৃত সত্য হল তা হয়নি , মহাভারতের যুদ্ধ একবারই হয়েছে । শ্রী কৃষ্ণ বললেন -

"আমি পূর্বে বিবস্বানকে ( অর্থাৎ সূর্য্যকে ) এই অব্যয় কর্মযোগ জ্ঞান বলেছিলাম, তিনি তাহা মনুকে ও মনু তাহা ইক্ষ্বাকুকে বলেছিলেন ।"

-------------- গীতা ৪ অধ্যায় ১ শ্লোক

অনেক পূর্বের জন্মে শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগ সম্পর্কিত জ্ঞান বিবস্বানকে বলেছিলেন , তিনি আবার তার পুত্র মনুকে বলেছিলেন , আবার মনু ইক্ষ্বাকুকে বলেছিলেন ।

এখন কথা হল গীতায় উল্লেখ্য বিবস্বান বা সূর্য্য বলতে আলো আর তাপ প্রদানকারী সূর্য্যকে বুঝি । আর মনু বলতে আমরা ৭ম মন্বন্তরের আদি পিতা বৈবস্বতকে বুঝি । কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল । তাহলে সত্য কি ? আসুন দেখে নেওয়া যাক  -

"পুনরায় ত্রেতা যুগের আরম্ভে সূর্য্য মনুকে এবং মনু সম্পূর্ণ জগতের কল্যাণের জন্য ইক্ষ্বাকুকে এই জ্ঞান দিয়েছেন । ইক্ষ্বাকুর উপদেশ এই শাশ্বত ধর্মের সম্পূর্ণ জগতে প্রচার করেছে । নরেশ্বর ! কল্পান্তে এই ধর্ম পুনরায় পরমেশ্বর নারায়ণকেই প্রাপ্ত হয়ে যায় ।"

------ মহাভারত/শান্তি পর্ব ৩৪৮/৫১ ও ৫২ শ্লোক

অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ আদি পিতা বৈবস্বত মনুকে ওই কর্মযোগ সম্পর্কিত জ্ঞান দেননি । কারণ বৈবস্বত মনু ত্রেতা যুগের অনেক পূর্বে তথা সত্যযুগেরও অনেক পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেছেন । আর বিবস্বান পুত্র মনু জন্ম গ্রহণ করেছেন ত্রেতা যুগের শুরুতে ।

আমরা সকলেই জানি ইতিমধ্যে ৬ টি মন্বন্তর চলে গেছে , বর্তমানে আমরা ৭ম মন্বন্তরে আছি । আবার ৭ম মন্বন্তরের মধ্যে ২৮তম চাতুর্যুগ চলছে । ৭১ চাতুর্যুগে ১মন্বন্তর হয় । অর্থাৎ আদি পিতা বৈবস্বত মনু ২৮টি চতুর্যুগের একেবারে শুরুতে অর্থাৎ ৭ম মন্বন্তরে শুরুতে জন্ম গ্রহণ করেছেন ।

অপর দিকে গীতায় উল্লেখিত বিবস্বান তথা সূর্য্য ও তার পুত্র মনু ৭ম মন্বন্তরের ২৮তম  চতুর্যুগের যে চার যুগ আছে তথা সত্য , ত্রেতা , দ্বাপর , কলি যুগ আছে , তার মধ্যে ত্রেতা যুগে জন্মে ছিলেন । অর্থাৎ  মহাভারতের মতে গীতা উক্ত এই  মনু কোনো ভাবেই আদি পিতা মনু নয় । গীতার মনু হলেন বিবস্বান নামক এক রাজার পুত্র মনু ও তার পুত্র ইক্ষ্বাকু ।

রাজাদের তথা গৃহাশ্রমে বসবাসকারীদের কর্মযোগ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না থাকলে তারা রাজ্য পরিচালনা ও সংসারে ভালোভাবে বসবাস করতে পারেনা তথা সংসার ধর্ম ভালোভাবে করতে পারে না ।

মুক্তাত্মা কৃষ্ণের বেদ উপনিষদে পূর্ণ জ্ঞান ছিল তার ফলে তিনি বৈদিক সেই কর্মযোগই বিবস্বান নামক রাজাকে বলেছিলেন আর এই কর্মযোগ সম্পর্কিত জ্ঞান বেদ উপনিষদে খুব ভালোকরে দেখতে পাই আমরা ।

কৃষ্ণ পূর্বে অনেকবার জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তার মনেও আছে সেই জন্মের কথা তা তিনি গীতার ৪ অধ্যায়ের ৫ শ্লোক ও ২ অধ্যায়ের ১২ শ্লোকে স্বীকার করেছেন । অর্থাৎ তিঁনিও যে জীবাত্মা ছিল তাও তিনি নিজেই বলেছেন ।

আর মহাভারতের মতে রাম চন্দ্রেরও সেই বিবস্বান তথা সূর্য্য বংশেই জন্ম হয়েছিল এবং রামচন্দ্র ছিলেন সেই বংশের ৫৮তম অধস্তন পুরুষ ।

অর্থাৎ গীতায় উক্ত বিবস্বান বা সূর্য্য , আলো বা তাপ দেওয়া সূর্য্য নয় । আর তার ছেলে মনুও ৭ম মন্বন্তরের আদি পিতা বৈবস্বত মনু নয় । এরা প্রত্যেকেই রাজা ছিলেন আর বৈদিক জ্ঞান সম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণ ওনার পূর্ব জন্মে তাদেরকে কর্মযোগ সম্পর্কে বলেছিলেন । কেননা সকলের মতো কৃষ্ণেরও বহু জন্ম হয়েছে এবং তিনি তা মনে রাখতে পারতেন ।
কারণ তিনি মুক্তাত্মা ছিলেন ।

যোগেশ্বর শব্দের অর্থ


"যোগেশ্বর" শব্দের অর্থ কি ?

গীতার ১৮ অধ্যায়ে ৭৫ ও ৭৮ শ্লোকে কৃষ্ণ জীকে

যোগেশ্বর কথন করা হয়েছে । 

"যোগ" শব্দের অনেক অর্থ হয় , যেমন -

"যোগঃ সংহনন-উপায় ধ্যান সঙ্গতি যুক্তিষু" অর্থাৎ এর অর্থ হল উপায় , কৌশল , সাধনা , যুক্তি ।

মহাভারতের নানা জায়গায় এই "যোগ" শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে , যেমন - দ্রোণাচাৰ্য বধের উপায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে "একোহি যোগোহস্য ভবেদ বধায়" অর্থাৎ উহাকে বধের একটি মাত্র উপায় বা কৌশল আছে । ঠিক তেমনি  ঈশ্বর প্রাপ্তিরও অনেক রকম যোগ বা উপায় বা কৌশল আছে , যেমন - কর্মযোগ , জ্ঞানযোগ , ধ্যানযোগ , ভক্তিযোগ প্রভৃতি ।

গীতায় অনেক জায়গায় যোগ শব্দ কর্ম যোগ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন গীতার ২ অধ্যায়ের ৫০ শ্লোকে বলা হয়েছে "যোগঃ কর্মসু কৌশলম" অর্থাৎ কর্মে কৌশলই যোগ" আর কৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলার কারণ হল শ্রীকৃষ্ণ কর্ম , কৌশল , যুক্তি , সাধনা ইত্যাদিতে অন্যান্য যোগীদের থেকে উত্তম বা সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন , তাই শ্রীকৃষ্ণ জীকে যোগেশ্বর কথন করা হয়েছে , এটা একটা উপাধিও বলা যায় ।


Thursday, July 30, 2020

পবিত্র বেদ ও গীতায় ওঁ জপ

পবিত্র বেদ ও গীতায় ওঁ জপ
__________________________________________

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
ওম্ ক্রতো স্মর। ক্লিবে স্মর। কৃতং স্মর।।
  
যজুর্বেদ ৪০/১৫ মন্ত্র


পদার্থ : 

(বায়ুরনিলমমৃতমথেদং) প্রানস্বরূপ বায়ু অবিনাশি কিন্তু (ভষ্মান্তং) ভষ্মেই অন্ত (শরীরম্) শরীরের তাই( ওম্ ক্রতো স্বর)  ওঁ স্বরন করো (ক্লিবে স্মর) নিজের স্বরূপকে স্বরন করো (কৃতং স্মর)  কর্মকে স্বরন করো ।

অর্থ : 

প্রানস্বরুপ বায়ু অবিনাশী কিন্ত শরীর বিনাশী ভষ্মেই তাহার অন্ত। তাই মৃত্যু কালে ওঁ স্বরন কর নিজের স্বরুপকে স্বরন করো নিজের কর্মকে স্বরন করো । 

ভাবার্থ : 

আত্মা অবিনাশী কিন্তু এই স্থূল শরীর বিনাশী তাহার অন্ত হয় ভষ্ম তথা অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার মাধ্যমে তাই হে জীব শরীর ত্যগ পূর্বে তুমি পরমাত্বার শ্রেষ্ঠ নাম ওঁ  উচ্চারন করো তাহাকে স্বরন পূর্বক জপ করো । নিজের স্বরূপকে স্বরন করো তুমি কেমন ছিলে কেমন আছ এবং পরবর্তীতে তোমার কি হইবে? তুমি স্বরন করো নিজের কর্মকে তুমি কি করেছো? কেমন করেছো ? কেন করেছো ? কেমন ছিলো তোমার কর্ম ? এরুপেই তুমি পরমাত্বাকে জানিতে ও প্রাপ্ত হইতে পারবে ।




ওম্ ইতি একাক্ষরম্ ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মাম্ অনুস্মরন্ ।
য়ঃ প্রযাতি ত্যজন্ দেহম্ সঃ যাতি পরামাম্ গতিম্ ।। 

গীতা ৮/১৩ শ্লোক 


পদার্থ 

 (ওম্, একাক্ষরম্, ব্রহ্ম) 'ওঁ' হলো এক অক্ষর ব্রহ্ম অর্থাৎ ব্রহ্মের বোধক যে 'ওঁ' অক্ষর আছে উহাকে (ব্যাহরন্) কথন করে (মাম্, অনুস্মরন্) আমাকে এর অনন্তর স্মরণ করে অর্থাৎ এই পদের উপদেষ্টা হিসেবে জেনে  (য়ঃ) যে পুরুষ (দেহম্, ত্যজন্) দেহকে  ত্যাগ করে  (প্রযাতি) মৃত্যু হয় (সঃ) সে (পরামাম্, গতিম্, যাতি) পরম গতি কে প্রাপ্ত হয়।।

ভাবার্থ 

যে পুরুষ 'ওঁ' নামক ব্রহ্ম অক্ষর কে স্মরণ করতে করতে দেহ ত্যাগ দ্বারা প্রয়াণ করে সে পুরুষ পরম গতি কে প্রাপ্ত হয়।।

ভাষ্য 

এখানে কথন করে যে 'ওঙ্কার' এর জপ সমাধি লাভে উপযোগী, যেমন 'ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্বা' যোগদর্শন ১/২৩ সূত্রে কথন করা হয়েছে যে ঈশ্বরের 'প্রণিধান' ভক্তি বিশেষ দ্বারা সমাধি লাভ হয়।।

এই শ্লোকের ব্যাখ্যাতে অবতারবাদী টীকাকারগণ এই অক্ষর কে কৃষ্ণের সাথে মিলিয়ে দেয় অর্থাৎ কৃষ্ণ কে পরমেশ্বর বলে কথন করে। যদি মহর্ষি ব্যাসজীর এমন তাৎপর্য হতো তাহলে এই অক্ষর এর অনন্তর কৃষ্ণজী 'মাম্ অনুস্মর' কথন কথন করতো না, আমাদের বিচারে কৃষ্ণজী নিজেই নিজেকে ওই অক্ষরের উপদেষ্টা হওয়ার কারণে মহত্ত্ব কথন করে, নিজে অক্ষর ব্রহ্ম হওয়ার অভিমানে নয়, যদি স্বয়ং অক্ষর= ব্রহ্ম হওয়ার অভিমান করতো তাহলে 'তমাহুঃ পরমাম্ গতিম্' গীতা ৮/২১ এই বাক্য দ্বারা ওই অক্ষর কে পরম গতি নিরুপণ করে নিজের ধাম কথন করতো না। 'ধাম' শব্দের অর্থ হলো স্থিতি স্থান অর্থাৎ আমার স্থিতির স্থান হয় সেই অক্ষর, এই কথন করে আবার সামনে গিয়ে ওই অক্ষর প্রাপ্তির অন্যান্য ভক্তি দ্বারা কথন করে।।


মধুর ওঁ ধ্বনির ভিডিও টি দেখুন 






বিদ্রোহী নারী নাঙ্গেলি



সমাজের জঘন্য কালো দিক আর সেই 
প্রেক্ষাপটে এক সাহসী মেয়ের লড়াইয়ের গল্প 
"মুলাকরম-The Brest Tax"



দক্ষিন ভারতে এমনই ঘৃণ্য প্রথা ছিল ঊনিশ শতকে ৷ 
যেখানে নিম্ন বর্ণের হিন্দু মহিলাদের অধিকার ছিল না বক্ষ আবরণী ব্যবহার করার ৷ মহিলাদের স্তন ঢেকে রাখতে গেলে স্তনের ওজন ও আকার অনুযায়ী দিতে হত "স্তন কর" বা "Brest Tax" ৷ স্থানীয় ভাষায় "মুলাকরম" ৷ সমাজের জঘন্য , কালো দিক আর সেই প্রেক্ষাপটে এক সাহসী মেয়ের লড়াইয়ের গল্প "মুলাকরম-The Brest Tax"



সে সময় হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজ নিয়ম করেছিল , নিম্ন বর্ণের মহিলারা বুকের উপর কোনও কাপড় পরিধান করতে পারবেন না ৷ এটা নাকি  তাঁদের ধর্ম বিরুদ্ধ ৷ যদি কেউ স্তন ঢাকার চেষ্টা করেন তবে তাঁকে "স্তন কর" দিতে হবে ৷ ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের এই নিয়ম দক্ষিন ভারতের একটি অঞ্চলে চালু ছিল ৷ সেই কর আদায় হতো মহিলাদের স্তনের আকার ও ওজনের উপর ভিত্তি করে ৷ করের টাকা স্থানীয় উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণরা ভাগ করতেন ৷ তবে সিংহভাগ টাকাই যেত পদ্মনাভ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের কাছে ৷



"মুলাকরম" ছবিতে সেই মেয়ের কথা বলা হয়েছে , যাঁর বলিদানে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল উচ্চবর্ণের জুলুম ৷ তাঁর নাম "নাঙ্গেলি" ৷



 সামাজিক এই কু-প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন তিনি ৷ 
কেটে ফেলেছিলেন নিজের স্তন দু’টি ৷ 



ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের ট্রাভানকোর রাজ্যের চেরথালায় বাস করতেন নাঙ্গেলি ৷ নিম্ন-হিন্দু ধর্মের এজহাভা গোত্রের ছিলেন তিনি । তাঁর স্বামীর নাম ছিল "চিরুকান্দার" । 



চাষাবাদ করে আর গৃহস্থলীর কাজ করে 
জীবন নির্বাহ করতেন তাঁরা 


কিন্তু সমাজের এই প্রথা মানতে রাজি হননি নাঙ্গেলি  ৷ 
কাপড়ে স্তন ঢেকে উচ্চবর্ণের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে ৷ তবে নাঙ্গেলির এই লড়াইয়ে সবসময় তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী ৷


তবে নাঙ্গেলি আর চিরুকান্দান "স্তন কর" দিতে পারেননি ৷ তার পরিবর্তে নিজের বক্ষযুগলই কেটে ফেলেছিলেন তেজস্বী ওই মেয়ে ৷ 



স্ত্রীর বিরহ সহ্য করতে না পেরে জ্বলন্ত চিতায় নিজে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে ছিলেন চিরুকান্দানও ৷ সম্ভবত সেটাই ভারতের প্রথম পুরুষের "সতীদাহ"



তবে কালের অতলে হারিয়ে গিয়েছে 
নাঙ্গেলি আর চিরুকান্দানের নাম


দেখুন সম্পূর্ণ মুলাকরম ফিল্মটি

Friday, July 17, 2020

গীতার অনুসন্ধান

maxresdefault
মধ্যযুগে শঙ্কর, রামানুজ দু’জনেই গীতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের বর্গে ফেলেছেন। স্মৃতি মানে পুরাণের চেয়ে ওপরে, কিন্তু শ্রুতির (বেদ) নীচে। গীতা নয়, বেদই শীর্ষে। বেঁচে থাকলে শঙ্কর, রামানুজ কেউই গীতাকে ‘জাতীয় গ্রন্থ’ বলতেন না। গীতার গুরুত্ব অন্যত্র। স্মৃতি, কিন্তু শ্রুতিতুল্য। অদ্বৈতবাদী শঙ্কর থেকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নিম্বার্ক বা দ্বৈতবাদী মধ্ব, সকলে এই স্মৃতি থেকেই বেছে নেন নিজস্ব দার্শনিক প্রস্থান। গীতার জন্য নয়, ব্যাসদেব বা বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়েই তাঁরা গীতাভাষ্য রচনা করছেন। এবং এক-একটি শব্দই আলাদা করে দেয় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি।৫১৫১ বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন তা গীতা আকার নেই।
 ভারত মহাসাগর অন্তর্গত যবদ্বীপে প্রথমে হিন্দু রাজ্য ছিল, 1478 খ্রিস্টাব্দে যখন যবদ্বীপে মুসলিম রাজ্য স্থাপিত হয় ৷ তখন যবদ্বীপের বাহুরাহু নামক জনৈক ব্রাহ্মণ বহু শত শাস্ত্র গ্রন্থ সাথে নিয়ে আত্মরক্ষার্থে বালিদ্বীপে এসেছিলেন। সেই ব্রাহ্মণের আনিত মহাভারতের ভীষ্পর্ব অন্তগর্ত এক গীতা পাওয়া গেছে যাতে মাত্র ৭০টি শ্লোক ছিল ৷ তাই বর্তমানে প্রচারিত ৭০০ শ্লোকযুক্ত গীতা প্রক্ষিপ্ত ৷
89154634_106640984284784_5694311101810868224_n

হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্য লিখিত                    ‘ভগবদ্গীতাসম্বন্দেপ্রক্ষিপ্তবাদেরপ্রতিবাদ’ নামক একটি প্রবন্ধ  পিডিএফ ফাইল আকারে দেওয়া হলো Pdf Download Link : ( Click here! )👈

গীতাতে কেবল ৭০টি শ্লোকমাত্র অবশিষ্ট ছিল ৷ কারণ ১৪৭৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব হতেই সমগ্র ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ ৭০০ শ্লোকযুক্ত গীতা প্রচারিত ছিল, তার প্রমাণ রামানুজাচার্য ও মধ্বাচার্যের গীতা ভাষ্য ৷ যদি আদি হতেই মহাভারতে গীতা সত্তর শ্লোকযুক্ত হতো তবে শ্রীরামানুজাচার্য (১০১৭-১১৩৭ খ্রিঃ)  সাতশত শ্লোকযুক্ত গীতার ওপর ভাষ্য লিখলেন কিভাবে? এছাড়া শ্রীমধ্বাচার্য (১২৩৮-১৩১৭ খ্রিঃ) সাতশত শ্লোকময়ী গীতার ওপর ‘গীতাভাষ্য’ ও ‘গীতা তাৎপর্য নির্ণয়’ নামক দুটি গ্রন্থ লেখেন ৷ অতএব, জাভাদ্বীপবাসী হিন্দুদের নিকট মহাভারত অন্তর্গত যে সাতশত শ্লোকযুক্ত গীতা ছিল তা ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দের পর মুসলমানদের হস্তক্ষেপের ফলে বহু শ্লোক নিষ্কাশিত হয়ে সত্তরটি শ্লোক মাত্র অবশিষ্ট ছিল ৷ 


রাজা রাম শাস্ত্রীর মতে “গীতায় প্রথমে শুধুমাত্র ৬০টি শ্লোক ছিল,পরে ৬টি পর্যায়ে ক্রমবর্ধিত হয়ে বর্তমান ৭০০ শ্লোক বিশিষ্ট গীতায় পরিনত হয়”
জার্মান গীতা বিশেষজ্ঞ অন হামবোল্ড বলেন “গীতা প্রথমে ১১টি অধ্যায়ে সম্পুর্ন ছিল, বাকি ৭টি পরিচ্ছেদ অনেক পরে সংযোজিত হয়েছে”
রিচার্ড গার্বে মনে করেন গীতার প্রথম লেখকের রচনা কাল ২০০-১০০খৃষ্টপুর্বাব্দে।
টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এল বেশম এক বক্তৃতায় বলেছিলেন “গীতা তিন পর্যায়ে তিনজন লেখকের রচনা। প্রথম পর্যায়ে ১ম অধ্যায়ে ৪৭ এবং ২য় পর্যায়ে ৩৮ টি, মোট ৮৫ টি শ্লোক নিয়ে গীতা রচিত হয়েছিল। এই শ্লোক গুলোতে ধর্ম যুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের দায়িত্ব ও প্রয়োজনিয়তার উপর গুরুত্ত আরোপ করা হয়েছিল। ২য় পর্যায়ে একজন বেদান্তবাদি লেখক অদ্বৈত ব্রহ্মের তথ্য যোগ করে গীতার কলেবর বৃদ্ধি করেন। শেষ পর্যায়ে একজন বিষ্ণু ভক্ত বিষ্ণুর অবতারত্ব সংযোজন পূর্বক বাসুদেব কৃূষ্ণের বিশ্বরূপ প্রতিস্থাপন করেন। মূলত সেই সময়কালেই পুরাণের চর্চা অধিকতর ছিল।”
কাথিয়াবার গন্ডাল স্টেটে ১১৭৯ সালে হাতে লেখা গীতার যে পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাতে প্রচলিত গীতা থেকে ২১টি অতিরিক্ত শ্লোক ও ২৫০টি পাঠান্তর দেখা যায়।
মাদ্রাজের ধর্মমন্ডলের মুদ্রিত গীতায় প্রচলিত গীতা থেকে ৩৭টি শ্লোক বাদ দিয়ে মহাভারতের উদ্যোগ,অনুশাসন ও শান্তি পর্বের ৮২টি শ্লোক গ্রহন পুর্বক ৭৪৫টি শ্লোকের গীতা তৈরি করা হয়।
১১শতকের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল-বেরুনী তাঁর গ্রন্থে গীতার যেসকল শ্লোকের উদ্বৃতি দিয়েছেন সেগুলো বর্তমান গীতায় নেই!
সম্রাট আকবরের সময় গীতার যে ফারসী অনুবাদ প্রকাশিত হয় তার শ্লোক সংখ্যা ছিল ৭৪০। অনেক পন্ডিত গীতার ৭৪৫ শ্লোককেই সমর্তন করেন। যদিও শংকরাচার্যের সময়ে ৭০০ শ্লোকের গীতার সন্ধান মিলে যা বর্তমানেও পাওয়া যায়।
গীতার রচনাকাল, রচয়ীতা, মহাভারতে গীতার সংযোজনের সময় ও পরবর্তিকালে এব কলেবর বৃদ্ধি নিয়ে বিবেকানন্দ বলেন, “শংকরভাষ্য রচনার পূর্বে গীতা সাধারন্যে খুব পরিচিত ছিলনা।সম্ভবত তিনিই গীতার রচনাকার ও মহাভারতে সংযোজনকারী”
আর আচার্য শংকরের মতে “গীতা শাস্ত্র বেদার্থ সার সংগ্রহ বিধায় উহা বেদানুকুল হওয়া উচিৎ। ওঁ-কার স্মরণ করে শ্রী কৃষ্ণ যোগশাস্ত্র দ্বারা অর্জুনকে উপনিষদের ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করেছিলেন।

 শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় মহাপুরুষদিগের চরিত্রের নৈতিক সমর্থনাৰ্থ কর্মযোগমূলক গীতা মহাভারতে উপযুক্ত কারণেই উপযুক্ত স্থানে সন্নিবেশিত হইয়াছে; এবং গীতা মহাভারতেরই এক অংশ হওয়া উচিত । সেই অনুমানই এই দুই গ্রন্থের রচনা তুলনা করিলেই অধিক দৃঢ় হয় । কিন্তু তুলনা করিবার পূর্বে, এই দুই গ্রন্থের বর্তমান স্বরূপ সম্বন্ধে একটু বিচার করা আবশ্যক প্ৰতীত হয় । শ্ৰীমৎশঙ্করাচাৰ্য স্বকীয় গীতাভাষ্যের আরম্ভে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, গীতাগ্রন্থে সাত শত শ্লোক আছে । এবং অধুনাপ্রাপ্ত সমস্ত সংস্করণেও অতগুলি শ্লোকই প্ৰাপ্ত হওয়া যায় । এই সাত শত শ্লোকের মধ্যে ১ শ্লোক ধৃতরাষ্ট্রের, ৪০ সঞ্জয়ের, ৮৪ অর্জুনের এবং ৫৭৫ ভগবানের । কিন্তু বোম্বাই নগরে গণপতি কৃষ্ণাজীর ছাপাখানায় মুদ্রিত মহাভারতের সংস্করণে, ভীষ্মপর্বে বর্ণিত গীতার আঠারো অধ্যায়ের পর যে অধ্যায় আরম্ভ হয়, তাহার (অর্থাৎ ভীষ্মপর্বের ৪৩ তম অধ্যায়ের) আরম্ভে সাড়ে পাঁচ শ্লোকে গীতামহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে, এবং উহাতে উক্ত হইয়াছে -

 ষট্‌শতানি সবিংশানি শ্লোকানাং প্ৰাহ কেশবঃ ৷
অর্জ্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশৎ সপ্তষষ্টিং তু সঞ্জয়ঃ ৷
ধৃতরাষ্ট্রঃ শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে ॥

অর্থাৎ “গীতায় কেশবের ৬২০, অর্জুনের ৫৭, সঞ্জয়ের ৬৭ এবং ধৃতরাষ্ট্রের ১; মিলিয়া সর্বশুদ্ধ ৭৪৫ শ্লোক আছে ।” মাদ্রাজ এলাকার প্রচলিত পাঠানুসারে কৃষ্ণাচাৰ্য কর্তৃক প্ৰকাশিত মহাভারতের সংস্করণেও এই শ্লোক পাওয়া যায়; কিন্তু কলিকাতায় মুদ্রিত মহাভারতে ইহা পাওয়া যায় না; এবং ভারতটীকাকার নীলকণ্ঠ তো এই ৫॥• শ্লোক “গৌড়ৈঃ ন পঠ্যন্তে” এইরূপ লিখিয়াছেন । তাই উহা প্ৰক্ষিপ্ত বলিয়া মনে হয় । কিন্তু ইহা প্ৰক্ষিপ্ত মনে করিলেও গীতার মধ্যে ৭৪৫ শ্লোক (অর্থাৎ অধুনাপ্রাপ্ত গ্ৰন্থসমূহের অতিরিক্ত ৪৫ শ্লোক) কে কবে জুড়িয়া দিয়াছে তাহা বলা যায় না । মহাভারত বহুবিস্তৃত গ্ৰন্থ হওয়ায় তাহাতে মধ্যে মধ্যে অন্য শ্লোক সন্নিবেশিত হওয়া কিংবা কোন শ্লোক বাহির করিয়া লওয়া অসম্ভব নহে । কিন্তু একথা গীতার সম্বন্ধে বলা যায় না । গীতাগ্ৰন্থ সর্বদাই পঠিত হওয়ায় বেদের ন্যায় সমস্ত গীতাও কণ্ঠস্থ করিতে পারিত পূর্বে এরূপ অনেক লোকও ছিল, এবং আজ পৰ্যন্ত কেহ কেহ আছে ! এই কারণে বর্তমান গীতার বেশী পাঠান্তর দেখা যায় না, এবং অল্প যে-কিছু ভিন্ন পাঠ আছে, তাহা টীকাকারেরা জানেন । তাছাড়া, এরূপ বলিতেও বাধা নাই যে, এই কারণেই গীতাগ্রন্থে বরাবর ৭০০ শ্লোক রক্ষিত হইয়াছে যে উহার মধ্যে কেহ ফেরফার করিতে না পারে । এখন প্রশ্ন এই যে, বোম্বাই ও মাদ্রাজে মুদ্রিত মহাভারতের সংস্করণেই ৪৫ শ্লোক - এবং, সে সমস্তও ভগবানেরই বেশী কোথা হইতে আসিল ? সঞ্জয় ও অর্জুনের শ্লোকের মোট সংখ্যা বর্তমান সংস্করণে এবং এই গণনাতে একই অর্থাৎ ১২৪; এবং একাদশ অধ্যায়ের “পশ্যামি দেবান” (১১, ১৫-৩১) ইত্যাদি ১৭ শ্লোকের সঙ্গে মতভেদের কারণে অন্য দশ শ্লোকও সঞ্জয়ের বলিয়া বিবেচিত হওয়া সম্ভব, তাই বলা যাইতে পায়ে যে, সঞ্জয় ও অর্জুনের শ্লোকের মোট সংখ্যা একই হইলেও প্রত্যেকের শ্লোকগুলি পৃথক পৃথক গণনা করিতে অল্প পার্থক্য হইয়া থাকিবে । কিন্তু বর্তমান সংস্করণে ভগবানের যে ৫৭৫ শ্লোক আছে, তাহার বদলে ৬২০ অর্থাৎ ৪৫ অধিক শ্লোক কোথা হইতে আসিল তাহার কোন ঠিকানা পাওয়া যাইতেছে না ! গীতার ‘স্তোত্র’ বা ‘ধ্যান’ বা এই প্ৰকার অন্য কোন প্রকরণের সমাবেশ উহার মধ্যে করা হইয়া থাকিবে ইহা যদি বল, তবে দেখি যে বোম্বায়ে মুদ্রিত মহাভারতের গ্রন্থে ঐ প্রকরণ নাই শুধু নহে, ঐ গ্রন্থের গীতাতেও সাত শত শ্লোকই আছে । অতএব বর্তমান সাতশত শ্লোকের গীতাকেই প্ৰমাণ মানা ভিন্ন গত্যন্তর নাই ।
Screenshot%2B%252825%2529
শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ ডাউনলোড পিডিএফ

ইহা হইল গীতার কথা । কিন্তু মহাভারতের দিকে দেখিলে বলিতে হয় যে, এই বিরোধ কিছুই নহে । স্বয়ং ভারতেই উক্ত হইয়াছে যে, মহাভারতসংহিতার শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষ । কিন্তু রাওবাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্য মহাভারতসম্বন্ধীয় স্বকীয় টীকাগ্রন্থে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, বর্তমান প্রকাশিত গ্ৰন্থসমূহে অতগুলি শ্লোক পাওয়া যায় না; এবং বিভিন্ন পর্বের অধ্যায়সংখ্যাও ভারতের আরম্ভে প্রদত্ত অনুক্ৰমণিকা অনুসারে নাই । এই অবস্থায়, গীতা ও মহাভারতের তুলনা করিবার জন্য এই গ্ৰন্থসমূহের কোন এক বিশেষ পুস্তক অবলম্বন করা ভিন্ন কাজ চলিতে পারে না; তাই, শ্ৰীমৎশঙ্করাচাৰ্য কর্তৃক প্ৰমাণ বলিয়া গৃহীত সপ্তশতশ্লোকী গীতাকে এবং কলিকাতার বাবু প্ৰতাপচন্দ্র রায়ের মুদ্রিত মহাভারতের পুস্তককে প্রমাণরূপে গ্ৰহণ করিয়া আমি এই দুই গ্রন্থের তুলনা করিয়াছি; এবং আমার এই গ্রন্থে উদ্ধৃত মহাভারতের শ্লোকসমূহের স্থাননির্দেশও কলিকাতার মুদ্রিত উক্ত মহাভারতের অনুসারেই করিয়াছি । এই শ্লোকগুলিকে বোম্বায়ের পুস্তকে কিংবা মাদ্রাজের পাঠক্রম অনুসরণ করিয়া মুদ্রিত কৃষ্ণাচাৰ্যের সংস্করণে দেখিতে হইবে, এবং যদি উহা আমার নির্দিষ্ট স্থানে না পাওয়া যায়, তবে একটু অগ্রপশ্চাৎ অনুসন্ধান করিলেই উহা পাওয়া যাইবে ।
89154634_106640984284784_5694311101810868224_n
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কথা অনুসারেঃ👉

মহাভারতে ভগবদ্গীতার উল্লেখ


সাতশো শ্লোকের গীতা এবং কলিকাতার বাবু প্ৰতাপচন্দ্র রায়ের মুদ্রিত মহাভারত তুলনা করিলে প্ৰথমেই দেখিতে পাওয়া যায় যে, ভগবদ্গীতা মহাভারতেরই এক অংশ; এবং স্বয়ং মহাভারতেই কয়েক স্থানে এই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় । প্ৰথম উল্লেখ আদিপর্বের আরম্ভে দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রদত্ত অনুক্ৰমণিকায় করা হইয়াছে । “পূৰ্ব্বোক্তং ভগবদ্‌গীতাপর্ব্ব ভীষ্মবধস্ততঃ” [মভা|আ|২|৬৯] এইরূপ পৰ্ববৰ্ণনায় প্ৰথমে বলিয়া তাহার পর আঠারো পর্বের অধ্যায়সমূহের এবং শ্লোকসমূহের সংখ্যা বলিবার সময় ভীষ্মপর্বের বর্ণনায় পুনর্বার ভগবদ্গীতার স্পষ্ট উল্লেখ এই প্রকারে করা হইয়াছে -
 কশ্মলং যত্র পার্থস্য বাসুদেবো মহামতিঃ ৷
মোহজং ন্যাশয়ামাস হেতুভির্মোক্ষদশিভিঃ ॥
“যাহাতে মোক্ষগৰ্ভ কারণ দেখাইয়া বাসুদেব অর্জুনের মনের মোহজ কশ্মল নাশ করিয়াছিলেন” [মভা|আ|২|২৪৭] । এই প্ৰকার আদিপর্বে [১|১৭৯] প্রথম অধ্যায়ে প্রত্যেক শ্লোকের আরম্ভে “যদাশ্রৌষং” বলিয়া, যখন ধৃতরাষ্ট্র বলিয়াছিলেন যে, দুর্যোধনাদির জয়প্রাপ্তিসম্বন্ধে কোন্‌ কোন্‌ প্রকারে আমার নিরাশা হইতেছে, তখন এই বর্ণনা আছে যে, “যখনই শুনিলাম যে, অর্জুনের মনে মোহ উৎপন্ন হইলে পর শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁহাকে বিশ্বরূপ দেখাইয়াছিলেন তখনই আমি জয়সম্বন্ধে নিরাশ হইলাম ।” আদিপর্বের এই তিন উল্লেখের পর শান্তিপর্বের শেষে নারায়ণীয় ধর্ম বলিবার সময় গীতার পুনর্বার নির্দেশ করিতে হইয়াছে ।
Screen-Shot-2012-06-23-at-8.52.08-PM
 নারায়ণীয়সাত্বতঐকান্তিক ও ভাগবত, এই চারই নাম সমানার্থক । নারায়ণীয়োপাখ্যানে [শা|৩৩৪-৩৫১] নারায়ণ ঋষি কিংবা ভগবান শ্বেতদ্বীপে নারদকে যে উপদেশ করিয়াছিলেন, সেই ভক্তিমূলক প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বর্ণিত হইয়াছে । বাসুদেবকে একান্তভাবে ভক্তি করিয়া জাগতিক ব্যবহার স্বধর্মানুসারে করিতে থাকিলেই মোক্ষলাভ হয়, ভাগবতধর্মের এই তত্ত্ব আমি পূর্ব প্রকরণসমূহে বলিয়া আসিয়াছি; এবং ইহাও বলা হইয়াছে যে, এই প্রকার ভগবদ্গীতাতেও কর্মযোগই সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর প্রতিপাদিত হইয়াছে । এই নারায়ণীয় ধর্মের পরম্পরা বর্ণনা করিবার সময় বৈশম্পায়ন জন্মেজয়কে বলিতেছেন যে, এই ধর্ম সাক্ষাৎ নারায়ণ হইতে নারদ প্ৰাপ্ত হন, এবং এই ধর্মই “কথিতো হরিগীতাসু সমাসবিধিকল্পতঃ” [মভা|শাং|৩৪৬|১০] হরিগীতা কিংবা ভগবদ্গীতায় কথিত হইয়াছে । সেইরূপ আবার পরে ৩৪৮ অধ্যায়ের ৮ শ্লোকে উক্ত হইয়াছে -
 সমুপোঢেষ্বনীকেষু কুরুপাণ্ডবয়োর্মৃধে ৷
অর্জ্জুনে বিমনস্কে চ গীতা ভগবতা স্বয়ম্‌ ॥

কৌরব ও পাণ্ডবদিগের যুদ্ধের সময় বিমনস্ক অর্জুনকে ভগবান ঐকান্তিক অথবা নারায়ণ-ধর্মের এই বিধিসমূহের উপদেশ করিয়াছিলেন; এবং সর্ব যুগে স্থিত নারায়ণ-ধর্মের পরম্পরা বলিয়া পুনরায় বলিয়াছেন যে, এই ধর্ম এবং যতিদিগের ধর্ম অর্থাৎ সন্ন্যাসধর্ম দুই-ই হরিগীতায় কথিত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৪৮|৫৩] । আদিপর্বে ও শান্তিপর্বে প্ৰদত্ত এই ছয় উল্লেখের অতিরিক্ত অশ্বমেধ পর্বের অন্তর্ভূত অনুগীতাপর্বেও আর একবার ভগবদ্গীতার উল্লেখ আছে । ভারতীয় যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকেরও পরে আর একদিন শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুন যখন একত্র বসিয়াছিলেন, তখন শ্ৰীকৃষ্ণ বলিলেন “এখন এখানে আমার থাকিবার কোন আবশ্যকতা নাই; দ্বারকায় যাইবার ইচ্ছা আছে”; ইহার উত্তরে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে অনুরোধ করিলেন যে, পূর্বে যুদ্ধের আরম্ভে তুমি আমাকে যে উপদেশ দিয়াছিলে তাহা আমি বিস্মৃত হইয়াছি, সেই জন্য পুনর্বার সেই উপদেশ আমাকে দাও [অশ্ব|১৬] । তখন এই অনুরোধ অনুসারে শ্ৰীকৃষ্ণ দ্বারকায় যাইবার পূর্বে অর্জুনকে অনুগীতা বলিয়াছিলেন । এই অনুগীতার প্রথমেই ভগবান বলিয়াছেন যে “যুদ্ধারম্ভে তোমাকে যে উপদেশ করিয়াছিলাম তুমি দুৰ্ভাগ্যবশত তাহা বিস্মৃত হইয়াছ । সেই উপদেশ পুনর্বার তোমাকে সেইরূপই বলা এখন আমার পক্ষেও অসম্ভব; তাই, তাহার বদলে আর কোন বিষয় তোমাকে বলিতেছি” [মভা|অশ্ব|অনুগীতা|১৬|৯-১৩] । ইহা চিন্তার যোগ্য যে, অনুগীতার কোন কোন প্রকরণ গীতার প্রকরণেরই অনুরূপ । অনুগীতার এই নির্দেশ-সমেত মহাভারতে ভগবদ্গীতার সাতবার স্পষ্ট উল্লেখ আছে । সুতরাং ভগবদ্গীতা বর্তমান মহাভারতেরই এক অংশ ইহা উহার আভ্যন্তরিন প্ৰমাণ হইতে স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে ।

শব্দসাদৃশ্য


কিন্তু সংশয়ের গতি নিরঙ্কুশ হয় এইজন্য উপর্যুক্ত সাত নির্দেশ হইতেও কাহারও কাহারও সন্তোষ হয় না । তাহারা বলেন যে, এই উল্লেখগুলিও ভারতে যে পরে ঢুকাইয়া দেওয়া হয় নাই তাহা কিরূপে সিদ্ধ হয় ? এই প্রকারে উঁহাদিগের মনে এই সংশয় যেমন-তেমনই থাকিয়া যায়, গীতা মহাভারতের এক অংশ কি না । গীতা গ্রন্থ ব্ৰহ্মজ্ঞানমূলক, এই ধারণা হইতেই এই সন্দেহ তো প্ৰথমে বাহির হয় । কিন্তু এই ধারণা ঠিক নহে, আমি পূর্বেই তাহা সবিস্তার দেখাইয়াছি; সুতরাং বস্তুত দেখিতে গেলে এই সন্দেহের কোন অবসরই থাকে না । তথাপি এই প্ৰমাণের উপরই নির্ভর না করিয়া, অন্য প্ৰমাণের দ্বারাও এই সন্দেহ কিরূপে মিথ্যা বলিয়া নির্ধারিত হয় তাহা এক্ষণে বলিতেছি । কোন দুই গ্ৰন্থ একই গ্ৰন্থকারের কি না এইরূপ সন্দেহ হইলে, কাব্যমীমাংসক প্রথমতঃ শব্দসাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য এই দুই বিষয়ের বিচার করিয়া থাকেন । তন্মধ্যে শব্দসাদৃশ্যে শুধু শব্দেরই সমাবেশ হয় না, কিন্তু উহাতে ভাষারীতিরও সমাবেশ করা হয় । এই দৃষ্টিতে বিচার করিবার সময় মহাভারতের ভাষার সহিত গীতার ভাষার মিল কতটা তাহা দেখা আবশ্যক । কিন্তু মহাভারত গ্ৰন্থ অতি বিস্তৃত হওয়ায়, উহাতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ভাষার রচনা ও ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে করা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - কর্ণপর্বে কৰ্ণার্জুনের যুদ্ধবৰ্ণনা দেখিলে, তাহার ভাষার ধরণ অন্য প্রকরণান্তৰ্গত ভাষা হইতে ভিন্ন লক্ষিত হইবে । তাই, মহাভারতের ভাষার সহিত গীতার ভাষার মিল আছে কিনা, তাহা নিশ্চিত বলা দুষ্কর । তথাপি সাধারণতঃ বিচার করিয়া দেখিলে পরলোকগত কাশীনাথপন্ত তৈলঙ্গ যেরূপ বলেন তদনুসারে গীতার ভাষা ও ছন্দোরচনা আর্ষ কিংবা প্রাচীন বলিতে হয় । 
(৺কাশীনাথ ত্ৰ্যম্বক তৈলঙ্গকৃত ভগবদ্গীতার ইংরাজী ভাষান্তর মোক্ষমূলর সাহেব সম্পাদিত প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালার মধ্যে (Sacred Books of the East Series, Vol. VIII.) ছাপা হইয়াছে । এই গ্রন্থে ইংরাজি ভাষাতেই গীতাসম্বন্ধে এক টীকাত্মক প্রবন্ধ প্রস্তাবনার আকারে সংযোজিত হইয়াছে । এই প্রকরণে ৺তৈলঙ্গের মতানুসারে যে উল্লেখ আছে তাহা (এক জায়গা ছাড়া) এই প্রস্তাবনাকে লক্ষ্য করিয়াই হইয়াছে ।)

উদাহরণ যথা - কাশীনাথপন্ত দেখাইয়াছেন যে, অন্ত [গী|২|১৬], ভাষা [গী|২|৫৪], ব্ৰহ্ম (= প্ৰকৃতি গী|১৪|৩), যোগ (= কর্মযোগ), পাদপুরক অব্যয় ‘হ’ [গী|২|৯] প্রভৃতি শব্দ গীতায় যে অর্থে প্ৰযুক্ত হইয়াছে সে অর্থে উহা কালিদাসাদির কাব্যের মধ্যে পাওয়া যায় না । এবং পাঠভেদ বশতই হউক না কেন, কিন্তু গীতার ১১|৩৫ শ্লোকের ‘নমস্কৃত্বা’; এই অপাণিনীয় শব্দ রাখা হইয়াছে, সেইরূপ গী|১১|৪৮ শ্লোকে ‘শক্য অহং’ এইরূপ অ-পাণিনীয় সন্ধিও আছে । সেইরূপ আবার “সেনানীনামহং স্কন্দঃ” [গী|১০|২৪] ইহাতে ‘সেনানীনাং’ এই ষষ্ঠিকারকও পাণিনি অনুসারে শুদ্ধ নহে । আর্ষবৃত্ত রচনার উদাহরণ ৺তৈলঙ্গ স্পষ্ট করিয়া বুঝান নাই । কিন্তু আমার মনে হয় যে, একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপ-বৰ্ণনার [গী|১১|১৫-৫০] ৩৬ শ্লোককে লক্ষ্য করিয়াই তিনি গীতার ছন্দোরচনাকে আর্ষ বলিয়া থাকিবেন । এই শ্লোকগুলির প্রত্যেক চরণে এগারো অক্ষর আছে, কিন্তু গণনার কোন নিয়ম নাই; এক চরণ ইন্দ্ৰবজ্র হয় তো দ্বিতীয়টা উপেন্দ্ৰবজ্র, তৃতীয় শালিনী হয় তো চতুর্থটা অন্য কোন প্রকারের । এইরূপ উক্ত ৩৬ শ্লোকে অর্থাৎ ১৪৪ চরণে বিভিন্ন জাতীয় মোটে এগারো চরণ পাওয়া যায় । তথাপি সেখানে এই নিয়মও দেখা যায় যে, প্ৰত্যেক চরণে এগারো অক্ষর আছে, এবং উহাদের মধ্যে প্ৰথম, চতুর্থ, অষ্টম এবং শেষের দুই অক্ষর গুরু; এবং ষষ্ঠ অক্ষর প্রায়ই লঘু । ইহা হইতে এই অনুমান হয় যে, ঋগ্‌বেদ ও উপনিষদের ত্রিষ্টুপবৃত্তের ঢং অনুসারেই এই শ্লোক রচিত হইয়াছে । কালিদাসের কাব্যে এইরূপ ১১ অক্ষরের বিষমবৃত্ত দেখিতে পাওয়া যায় না । হাঁ, শকুন্তলা নাটকে “অমী বেদিং পরিতঃ ক?প্তধিষ্ণাঃ” এই শ্লোক এই ছন্দেরই; কিন্তু কালিদাসই উহাকে ‘ঋক্‌ছন্দ” অৰ্থাৎ ঋগ্বেদের ছন্দ বলিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, আর্ষবৃত্ত প্ৰচলিত থাকা কালেই গীতা গ্ৰন্থ রচিত হইয়াছিল । মহাভারতের অন্যত্রও এইরূপ আৰ্ষশব্দ ও বৈদিকবৃত্ত দেখিতে পাওয়া যায় । কিন্তু ইহার অতিরিক্ত এই দুই গ্রন্থের ভাষাসাদৃশ্যের দ্বিতীয় দৃঢ় প্রমাণ এই যে, মহাভারত ও গীতাতে একই রকম অনেক শ্লোক পাওয়া যায় । মহাভারতের সমস্ত শ্লোক অনুসন্ধান করিয়া তন্মধ্যে গীতায় কতগুলি আসিয়াছে, তাহা অভ্ৰান্তরূপে স্থির করা কঠিন । তথাপি মহাভারত পড়িবার সময় উহাতে যে শ্লোক ন্যুনাধিক পাঠভেদে গীতার শ্লোকের অনুরূপ আমি দেখিতে পাইয়াছি তাহারও সংখ্যা বড় কম নহে; এবং উহার ভিত্তিতে ভাষা সাদৃশ্যের প্রশ্নের সিদ্ধান্তও সহজেই হইতে পারে । নিম্নপ্রদত্ত শ্লোক ও শ্লোকার্ধ, গীতা ও মহাভারতে (কলিকাতা সংস্করণ) শব্দশ কিংবা দুই-এক শব্দের ভেদে একই রকম পাওয়া যায় –

উল্লেখ
মন্তব্য (গীতা)
 উল্লেখ
মন্তব্য (মহাভারত)
1|9
শ্লোকার্ধভীষ্ম|51|4গীতার মতই দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিকট স্বীয় সৈন্যের বর্ণনা করিতেছেন
1|10
শ্লোকভীষ্ম|51|6

1|12-19
আট শ্লোকভীষ্ম|51|22-29অল্প শব্দভেদে শেষ গীতার শ্লোকেরই মত
1|45
শ্লোক
দ্রোণ|197|50
অল্প শব্দভেদে শেষ গীতার শ্লোকের মত
2|19
শ্লোকার্ধ
শান্তি|224|14
অল্প পাঠভেদে বলিবাসাব-সংবাদে ও কঠোপনিষদে (2|18) আছে
2|28
শ্লোক
স্ত্রী|2|6; 9|11
অব্যক্ত’ ইহার বদলে অভাব’, বাকী একই
2|31
শ্লোকার্ধ
ভীষ্ম|124|36
ভীষ্ম কৰ্ণকে ইহাই বলিতেছেন
2|32
শ্লোক
কৰ্ণ|57|2
পার্থর বদলে'কর্ণপদ রাখিয়া দুৰ্যোধন কর্ণকে বলিতেছেন
2|46
শ্লোক
উদ্যোগ|45|26
সনৎসুজাতীয় প্ৰকরণে অল্প শব্দভেদে আসিয়াছে
2|59
শ্লোক
শান্তি|204|16
মনু-বৃহস্পতি-সংবাদে অক্ষরশ আসিয়াছে
2|67
শ্লোক
বন|214|26অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে এবং প্রথমে রথের রূপকও প্ৰদত্ত হইয়াছে
2|70
শ্লোক
শান্তি|250|9
শুকানুপ্রশ্নে মধ্যে অক্ষরশ আসিয়াছে
3|42
শ্লোক
শান্তি|245|3; 247|2অল্প পাঠভেদে শুকানুপ্রশ্নে দুইবার আসিয়াছে । কিন্তু এই শ্লোকের মূল কঠোপনিষদে ।
4|7
শ্লোক
বন|189-27
মার্কণ্ডের প্রশ্নে অক্ষরশ আসিয়াছে
4|31
শ্লোকার্ধশান্তি|267|40গোকাপিলীয়াখ্যানে আসিয়াছে এবং সমস্ত প্রকরণ যজ্ঞবিষয়কই
4|40
শ্লোকার্ধ
বন|199|110
মার্কণ্ডেয়সমস্যপর্বে শব্দশ প্রদত্ত হইয়াছে
5|5
শ্লোক
শান্তি|305|19; 316|4
এই দুই স্থানে অল্প পাঠভেদে বশিষ্ঠকরাল ও যাজ্ঞবল্ক্য-জনক সংবাদে আসিয়াছে
5|18
শ্লোক
শান্তি|238|19
শুকানুপ্রশ্নে অক্ষরশ আসিয়াছে
6|5
শ্লোকার্ধ এবং পরবর্তী শ্লোকের পূর্বার্ধ
উদ্যোগ|33|63-64
বিদুরনীতিতে অক্ষরশ আসিয়াছে
6|29
শ্লোকার্ধ
শান্তি|238|21
শুকানুপ্রশ্ন, মনুস্মৃতি (মনু|12|91), ঈশাবাস্যোপনিষদ (6ও কৈবল্য উপনিষদে (1|10অক্ষরশ আসিয়াছে
6|44
শ্লোকার্ধ
শান্তি|235|7
শুকানুপ্রশ্নে অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে
8|17
শ্লোক - প্ৰথমে যুগের অর্থ না বলিয়া গীতায় প্রদত্ত হইয়াছে
শান্তি|231|31
শুকানুপ্রশ্নে অক্ষরশ আসিয়াছে এবং যুগের অর্থবোধক তালিকাও প্ৰথমে প্রদত্ত হইয়াছে । মনুস্মৃতিতেও অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে (মনু|1|73
8|20
শ্লোকার্ধ
শান্তি|339|23
নারায়ণীয় ধর্মে অল্প পাঠভেদে দুইবার আসিয়াছে
9|32
শ্লোক এবং পরবর্তী শ্লোকের পূর্বার্ধ
অশ্ব|19|61-62
অনুগীতায় অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে
13|13
শ্লোক
শান্তি|238|29; অশ্ব|19|49
শুকানুপ্ৰশ্নঅনুগীতা এবং অন্যত্রও অক্ষরশ আসিয়াছে । এই শ্লোকের মূল শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে (শ্বে|3|16)
13|30
শ্লোক
শান্তি|17|23
যুধিষ্ঠির অর্জুনকে এই শব্দই বলিয়াছেন
14|18
শ্লোক
অশ্ব|39|10
অনুগীতার গুরুশিষ্যসংবাদে অক্ষরশ প্রদত্ত হইয়াছে
16|21
শ্লোকার্ধ
উদ্যোগ|32|70
বিদূরনীতিতে অক্ষরশ আসিয়াছে
17|3
শ্লোক
শান্তি|263|17
তুলাধার-জাজলিসংবাদে শ্রদ্ধা প্ৰকরণে আসিয়াছে
18|14
শ্লোক
শান্তি|347|87
নারায়ণীয় ধর্মে অক্ষরশ আসিয়াছে

উক্ত তুলনা হইতে বুঝা যায় যে, ২৭ সমগ্ৰ শ্লোক, ১২ শ্লোকার্ধ গীতা ও মহাভারতের বিভিন্ন প্রকরণে কখনও কখনও  অক্ষরশ এবং কখন বা অল্প পাঠভেদে একই; এবং ভাল করিয়া খুঁজিলে আরও অনেক শ্লোক ও শ্লোকার্ধ পাওয়া সম্ভব । যদি ইহা দেখিতে চাও যে, দুই দুই কিংবা তিন তিন শব্দ অধবা শ্লোকের চতুর্থাংশ (চরণ) গীতা ও মহাভারতে কত স্থানে একই আছে, তাহা হইলে উপরের তালিকা খুবই বাড়াইতে হয় ।
(সমস্ত মহাভারত এই দৃষ্টিতে দেখিলে, গীতা ও মহাভারতে সমান শ্লোকপাদ অর্থাৎ চরণ একশতেরও অধিক পাওয়া যাইতে পারে । তন্মধ্যে কতকগুলি এখানে দিতেছি – কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা [গী|১|৩২], নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে [গী|২|৩], ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ [গী|২|৪০], অশান্তস্য কুতঃ সুখম্‌ [২|৬৬], উৎসীদেয়ুরিমে লোকাঃ [৩|২৪], মনো দুর্নিগ্রহং চলম্‌ [৬|৩৫], মমাত্মা ভূতভাবনঃ [৯|৫], মোঘাশা মোঘকর্ম্মাণঃ [৯|১২], সমঃ সর্ব্বেষু ভূতেষু [৯|২৯], দীপ্তানলার্কদ্যুর্তিং [১|১৭], সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ [১২|৪], তুল্যনিন্দাস্তুতিঃ [১২|১৯], সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ [১২|১৯], সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ [১৪|২৪], ত্রিবিধা কর্মচোদনা [১৮|১৮], নির্ম্মমঃ শান্তঃ [১৮|৫৩], ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে [১৮|৫৩] ইত্যাদি ।)

কিন্তু এই শব্দসাম্যের অতিরিক্ত কেবল উপরিউক্ত তালিকার শ্লোক সাদৃশ্যই বিচার করিলে মহাভারতের অন্য প্রকরণ এবং গীতা যে একই হাতের, ইহা না বলিয়া থাকা যায় না । প্ৰত্যেক প্ৰকরণ ধরিয়া বিচার করিলেও উক্ত ৩৩ শ্লোকের মধ্যে 1 মার্কণ্ডেয় প্রশ্নে, ½ মার্কণ্ডেয়সমস্যাতে, 1 ব্ৰাহ্মণ-ব্যাধসংবাদে, 2 বিদুরনীতিতে, 1 সনৎসুজাতীয়ে, 1 মনুবৃহস্পতিসংবাদে, 6½ শুকানুপ্রশ্নে, 1 তুলাধার জাজিলিসংবাদে, 1 বশিষ্ঠকরাল ও যাজ্ঞবল্কজ্যনক সংবাদে, 1½ নারায়ণীয় ধর্মে, 2 অনুগীতায় এবং বাকি ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও স্ত্রীপর্বে প্রদত্ত হইয়াছে । তন্মধ্যে প্রায় সকল স্থানে এই শ্লোক পূর্বাপর সন্দর্ভ অনুসারে যথাযোগ্য স্থানেই সন্নিবেশিত হইয়াছে, - প্ৰক্ষিপ্ত নহে, এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায়; এবং ইহাও প্রতীত হয় যে, ইহাদের মধ্যে কোন কোন শ্লোক গীতাতেই সমারোপদৃষ্টিতে গৃহীত হইয়াছে । উদাহরণ যথা — “সহস্ৰযুগপৰ্যন্তং” [গী|৮|১৭] এই শ্লোক স্পষ্ট বুঝাইবার জন্য প্ৰথমে বৎসর ও যুগের ব্যাখ্যা দেওয়া আবশ্যক ছিল; এবং মহাভারতে [শাং|২৩১] ও মনুস্মৃতিতে এই শ্লোকের পুর্বে উহাদের লক্ষণও দেওয়া হইয়াছে । কিন্তু গীতায় এই শ্লোক যুগ প্ৰভৃতির ব্যাখ্যা না দিয়া একেবারেই উক্ত হইয়াছে । এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে মহাভারতের অন্য প্রকরণে এই শ্লোক গীতা হইতেই উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা বলিতে পারা যায় না; এবং এত বিভিন্ন প্রকরণ হইতে এই সমস্ত শ্লোক গীতায় গৃহীত হওয়া সম্ভব নহে । অতএব গীতা ও মহাভারতের এই সকল প্রকরণের লেখক একই ব্যক্তি, ইহাই অনুমান করিতে হয় । ইহাও এইস্থানে বলা আবশ্যক যে, মনুস্মৃতির অনেক শ্লোক যেরূপ মহাভারতে পাওয়া যায়, * সেইপ্ৰকার গীতার “সহস্ৰযুগপৰ্যন্তং” [৮|১৭] এই পুরো শ্লোকটি অল্প পাঠভেদে এবং “শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ” [গী|৩|৩৫ ও ১৮|৩৭] এই শ্লোকার্ধ – ‘শ্রেয়ান্‌’এর বদলে ‘বরং’ এই পাঠভেদে এবং “সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং” এই শ্লোকার্ধও [গী|৬|২৯] “সর্ব্বভূতেষু চাত্মানং” এই রূপভেদে মনুস্মৃতিতে পাওয়া যায় [মনু|১|৭৩; ১০|৯৭; ১০|৯১] । মহাভারতের অনুশাসনপর্বে এইরূপ মনুস্মৃতির স্পষ্ট উল্লেখ আছে ।
(মনুস্মৃতির কোন্‌ কোন্‌ শ্লোক মহাভারতে পাওয়া যায় তাহার এক তালিকা, বুহ্লর সাহেবের ‘প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালায়’ মুদ্রিত মনুর ইংরাজী ভাষান্তরে যোজিত হইয়াছে তাহা দেখ (S.B.E. Vol XXV. Pp.533.)

অর্থসাদৃশ্য


শব্দসাদৃশ্যের বদলে অর্থসাদৃশ্য দেখিলেও এই অনুমানই দৃঢ় হয় । গীতার কর্মযোগমার্গ ও প্ৰবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্ম বা নারায়ণীয় ধর্মের সাম্য আমি পূর্ব প্রকরণসমূহে ইঙ্গিত করিয়া আসিয়াছি । বাসুদেব হইতে সংকর্ষণ, সংকর্ষণ হইতে প্ৰদ্যুম্ন, প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ এবং অনিরুদ্ধ হইতে ব্ৰহ্মদেব, ব্যক্ত সৃষ্টির উপপত্তির এই যে পরম্পরা নারায়ণীয় ধর্মে প্রদত্ত হইয়াছে তাহা গীতায় গৃহীত হয় নাই । ইহার অতিরিক্ত ইহাও সত্য যে, গীতাধর্ম ও নারায়ণীয় ধর্মে অনেক ভেদ আছে । কিন্তু চতুর্ব্যুহ পরমেশ্বরের কল্পনা গীতার মান্য না হইলেও গীতার নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তের উপর বিচার করিলে প্ৰতীত হয় যে, গীতাধর্ম ও ভাগবতধর্ম একই প্রকারের । সিদ্ধান্তটা এই - এক ব্যুহ বাসুদেবের প্রতি ভক্তিই রাজমাৰ্গ, অন্য কোন দেবতার প্রতি ভক্তি গেলেও তাহা বাসুদেবেরই প্ৰতি অৰ্পিত হয়; ‘ভক্ত চারি প্রকারের হইয়া থাকে; ভগবদভক্তকে স্বধর্মানুসারে সমস্ত কর্মের অনুষ্ঠান করিয়া যজ্ঞচক্ৰ বজায় রাখিতেই হইবে এবং সন্ন্যাসগ্রহণ করা উচিত নহে । ইহাও পূর্বে বলিয়াছি যে, বিবস্বান-মনু-ইক্ষ্বাকু প্ৰভৃতি সম্প্রদায়পরম্পরাও উভয় দিকে একই। সেইরূপ আবার সনৎসুজাতীয়, শুকানুপ্রশ্ন, যাজ্ঞবল্ক্যজনকসংবাদ, অনুগীতা ইত্যাদি প্রকরণ পড়িলে বুঝা যাইবে যে, গীতার বেদান্ত বা অধ্যাত্মজ্ঞানেরও উক্ত প্রকরণসমূহে প্ৰতিপাদিত ব্ৰহ্মজ্ঞানের সহিত মিল আছে । কাপিল-সাংখ্যশাস্ত্রের ২৫ তত্ত্ব ও গুণোৎকর্ষের সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়াও ভগবদ্গীতা যে প্রকার প্রকৃতি ও পুরুষেরও অতীত কোন নিত্য তত্ত্ব আছে বলিয়া মানিয়া থাকেন, সেইরূপই শান্তিপর্বের বশিষ্ঠকরালসংবাদে ও যাজ্ঞবল্ক্যজনকসংবাদে সবিস্তার ইহা প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে, সাংখ্যাদিগের ২৫ তত্ত্বের অতীত আর এক ‘ষড়্‌বিংশতিতম’ তত্ত্ব আছে, যাহার জ্ঞান না হইলে কৈবল্য লাভ হয় না ।

এই বিচারসাম্য কেবল কর্মযোগ বা অধ্যাত্ম এই দুই বিষয়ের সম্বন্ধেই দেখা যায় না; কিন্তু এই দুই মুখ্য বিষয়ের অতিরিক্ত গীতাতে যে অন্যান্য বিষয় আছে তাহাদেরই সদৃশ প্রকরণও মহাভারতে কয়েকস্থানে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - গীতার প্ৰথম অধ্যায়ের আরম্ভেই দুর্যোধন দ্ৰোণাচার্যের নিকট উভয় সৈন্যের যেরূপ বর্ণনা করিয়াছেন ঠিক সেইরূপ বৰ্ণনাই পরে ভীষ্মপর্বের ৫১ অধ্যায়ে তিনি পুনর্বার দ্রোণাচার্যেরই নিকট করিয়াছেন । প্ৰথম অধ্যায়ের উত্তরার্ধে অর্জুনের যেরূপ বিষাদ হইয়াছিল, সেইরূপই শান্তিপর্বের আরম্ভে যুধিষ্টিরের হইয়াছিল; এবং যখন ভীষ্ম ও দ্রোণের “যোগবলে” নিহত হইবার সময় নিকটবর্তী হইল, তখন অর্জুনের মুখ হইতে পুনর্বার ঐরূপই বিষাদপূৰ্ণ কথা বাহির হইয়াছিল [ভীষ্ম|৯৭|৪-৭; ১০৮|৮৮-৯৪] । অর্জুন গীতার আরম্ভে বলিয়াছেন যে, যাঁহাদের জন্য বিষয়োপভোগ করিতে হইবে তাহাদিগকে বধ করিয়া জয়লাভ করিলেই বা কি ফল [গী|১|৩২, ৩৩] আবার, যখন যুদ্ধে সমস্ত কৌরবের ক্ষয় হইল তখন ঐ কথাই দুৰ্যোধনের মুখ হইতেও বাহির হইয়াছে [শল্য|৩১|৪২-৫১] । দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে যেমন সাংখ্য ও কর্মযোগ এই দুই নিষ্ঠার কথা বলা হইয়াছে সেইরূপই নারায়ণীয় ধর্মে এবং শান্তিপর্বের জাপকোপাখ্যানে ও জনকসুলভাসংবাদেও এই নিষ্ঠার বর্ণনা আছে [শাং|১৯৬, ৩২০] । তৃতীয় অধ্যায়ের অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম না করিলে পেটও ভরে না, ইত্যাদি বিচার বনপর্বের আরম্ভে দ্ৰৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছেন [বন|৩২]; এবং এই তত্ত্বেরই উল্লেখ অনুগীতাতেও পুনর্বার করা হইয়াছে । শ্রৌতধর্ম বা স্মার্তধর্ম যজ্ঞময়, যজ্ঞ ও প্রজা ব্ৰহ্মদেব একসঙ্গেই নির্মাণ করিয়াছেন, ইত্যাদি গীতার প্রবচন নারায়ণীয় ধর্ম ছাড়া শান্তিপর্বের অন্য স্থানে [শাং|২৪৭] এবং মনুস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|৩]; এবং স্বধর্মানুযায়ী কর্মসাধনে পাপ নাই এই বিচার তুলাধার জাজলি-সংবাদে ও ব্রাহ্মণ-ব্যাধসংবাদেও প্রদত্ত হইয়াছে [শাং|২৬০-২৬৩ এবং বন|২০৬-২১৫] । এতদ্ব্যতীত, গীতার সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে জগদ্যুৎপত্ত্বির যে অল্প কিছু বর্ণনা আছে, তাহারই অনুরূপ বৰ্ণনা শান্তিপর্বের শুকানুপ্রশ্নেও আছে [শাং|২৩১]; এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাতঞ্জল যোগের আসনের যে বৰ্ণনা আছে, তাহাই পুনৰ্বার শুকানুপ্রশ্নে [শান্তি|২৩৯] ও পরে শান্তিপর্বের ৩০০ অধ্যায়ে এবং অনুগীতাতেও সবিস্তার বিবৃত হইয়াছে [অশ্ব|১৯] । অনুগীতার গুরুশিষ্যসংবাদে কৃত মধ্যম-উত্তম বস্তুসমূহের বর্ণনা [অশ্ব|৪৩, ৪৪] এবং গীতার দশম অধ্যায়ের বিভূতি-বর্ণনা, এই উভয়ের প্রায় একই অর্থ, এরূপ বলিতে বাধা নাই । মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, গীতায় ভগবান অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখাইয়াছিলেন, তাহাই সন্ধিপ্ৰস্তাবের সময় দুর্যোধনাদি কৌরবদিগকে এবং পরে যুদ্ধ শেষ হইলে দ্বারকায় ফিরিয়া যাইবার পথে উত্তঙ্ককে, এবং নারায়ণ নারদকে এবং দাশরথি রাম পরশুরামকে দেখাইয়াছিলেন [উ|১৩০; অশ্ব|৫৫; শাং|৩৩৯; বন|৯৯] । ইহা নিঃসন্দেহ যে, গীতার বিশ্বরূপ—বর্ণনা এই চারি স্থানের বর্ণনাপেক্ষা সরস ও বিস্তৃত; কিন্তু এই সমস্ত বর্ণনা পাঠ করিলে সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, অর্থসাদৃশ্যের দৃষ্টিতে সেগুলিতে কিছুই নূতনত্ব নাই । গীতার চতুর্দশ ও পঞ্চদশ অধ্যায়ে নিরূপণ করা হইয়াছে যে, সত্ব রজ ও তম এই তিন গুণ প্ৰযুক্ত জগতের মধ্যে বৈচিত্ৰ্য কিরূপে উৎপন্ন হয়, এই গুণত্রয়ের লক্ষণ কি, এবং সমস্ত কর্তৃত্ব গুণেরই, আত্মার নহে; ঠিক এই প্রকার এই তিন গুণের বর্ণনা অনুগীতায় [অশ্ব|৩৬-৩৯] এবং শান্তিপর্বেও অনেকস্থানে প্ৰদত্ত হইয়াছে [শাং|২৮৫ ও ৩০০-৩১১] । সারকথা, গীতার প্রসঙ্গ অনুসারে গীতায় কোন কোন বিষয়ের আলোচনা বিস্তৃত হইয়া গিয়াছে এবং গীতার বিষয়-বিচারপদ্ধতিও কিছু ভিন্ন, তথাপি দেখা যায় যে, গীতার সমস্ত বিচারের অনুরূপ বিচার মহাভারতেও পৃথক পৃথক কোথাও-না-কোথাও ন্যুনাধিক পরিমাণে পাওয়াই যায়; এবং বিচারসাম্যের সঙ্গে সঙ্গেই শব্দেরও ন্যুনাধিক সাম্য স্বতই সংঘটিত হয়, ইহা বলা বাহুল্য । মাৰ্গশীর্ষ মাসের সম্বন্ধে সাদৃশ্য তো বিলক্ষণই আছে । গীতায় “মাসানাং মাৰ্গশীর্ষোহহং” [গী|১০|৩৫] বলিয়া এই মাসকে যে প্ৰকার প্রথম স্থান দেওয়া হইয়াছে, সেইরূপই অনুশাসনপর্বের দানধর্ম প্ৰকরণে যেখানে উপবাসের জন্য মাসগুলির নাম বলিবার প্রসঙ্গ দুইবার আসিয়াছে, সেইখানে প্ৰত্যেকবার মাৰ্গশীর্ষ হইতেই মাসগুলির গণনা শুরু করা হইয়াছে [অনু|১০৬ ও ১০৯] । গীতার আত্মৌপম্যের কিংবা সর্বভূতহিতের দৃষ্টি, অথবা আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক ভেদ, এবং দেবযান ও পিতৃযান গতির উল্লেখ মহাভারতের অনেক স্থানে পাওয়া যায় । এই সম্বন্ধে পূর্বপ্রকরণসমূহে সবিস্তার আলোচনা করিয়াছি বলিয়া এখানে তাহার পুনরুক্তি করিলাম না ।

সিদ্ধান্ত


ভাষা সাদৃশ্যই ধর, বা অর্থসাদৃশ্যই ধর, কিংবা গীতাসম্বন্ধে মহাভারতে যে ছয় সাত বার উল্লেখ পাওয়া যায় তাহার উপর বিচার কর; এইরূপ অনুমান না করিয়া থাকা যায় না যে, গীতা বর্তমান মহাভারতেরই এক অংশ, এবং যে ব্যক্তি বর্তমান মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন তিনিই বর্তমান গীতাও বিবৃত করিয়াছেন । এই সমস্ত প্ৰমাণ উপেক্ষা করিয়া কিংবা কোন প্ৰকারে উহাদের মনগড়া অৰ্থ লাগাইয়া কোন কোন ব্যক্তি গীতাকে প্ৰক্ষিপ্ত দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাহা আমি অবগত আছি । কিন্তু যাহারা বাহ্য প্রমাণকে মানেন না এবং নিজেরই সংশয়পিশাচকে অগ্ৰস্থান দেন, তাহাদের বিচারপদ্ধতি নিতান্ত অশাস্ত্রীয় সুতরাং অগ্ৰাহ্য । মহাভারতের মধ্যে গীতাকে কেন স্থান দেওয়া হইল ইহার কোন উপপত্তিই যদি প্ৰকাশ না পাইত, তাহা হইলে অন্য কথা ছিল । কিন্তু (এই প্রকরণের আরম্ভে যেমন বলা হইয়াছে) গীতা নিছক বেদান্তমূলক কিংবা ভক্তিমূলক নহে, কিন্তু যে প্ৰমাণভূত মহাপুরুষদিগের চরিত্র মহাভারতে বৰ্ণিত হইয়াছে, তাহাদিগের চরিত্রের নীতিতত্ত্ব বা মর্ম বলিবার জন্য মহাভারতে কর্মযোগমূলক গীতার নিরূপণ অত্যন্ত আবশ্যক ছিল; এবং বর্তমান সময়ে মহাভারতের যে স্থানে উহা বিবৃত হইয়াছে তাহা অপেক্ষা কাব্যদৃষ্টিতে ও উহার উল্লেখের জন্য অধিকতর কোন যোগ্যস্থল দেখা যায় না । ইহা সিদ্ধ হইলে পর, গীতা মহাভারতের মধ্যে যোগ্য কারণে ও যোগ্যস্থানেই সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, প্রক্ষিপ্ত নহে, এই সিদ্ধান্তই শেষে বজায় থাকে । মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও একটি সর্বমান্য ও উৎকৃষ্ট আর্ষ মহাকাব্য; এবং তাহাতেও কথাপ্ৰসঙ্গানুসারে সত্য, পুত্ৰধর্ম, মাতৃধর্ম, রাজধর্ম প্রভৃতির মর্মস্পর্শী আলোচনা আছে । কিন্তু ইহা বলিবার প্রয়োজন নাই যে, নিজের কাব্যকে মহাভারতের ন্যায় “অনেক সময়ান্বিত, সূক্ষ্ম ধর্মাধর্মের অনেক নীতিতত্ত্বে পূর্ণ, এবং সমস্ত লোকের শীল ও সচ্চরিত্র-শিক্ষাবিধানে সর্বপ্রকারে সমৰ্থ” করা বাল্মীকি ঋষির মূল উদ্দেশ্য ছিল না; তাই ধর্মাধর্মের কার্যাকার্যের বা নীতির দৃষ্টিতে, মহাভারতের যোগ্যতা রামায়ণ অপেক্ষা অধিক । মহাভারত শুধু আর্ষ কাব্য বা শুধু ইতিহাস নহে; কিন্তু উহা ধর্মাধর্মের সূক্ষ্ম প্রসঙ্গের নির্ণয়কারী এক সংহিতা; এবং এই ধর্মসংহিতা র মধ্যে যদি কর্মযোগের শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক বিচার না করা হয়, তবে তাহা আর কোথায় করা যাইতে পারে ? শুধু বেদান্তসম্বন্ধীয় গ্রন্থে এই বিচার-আলোচনা করা যাইতে পারে না, ধর্মসংহিতাই উহার উপযুক্ত স্থান; এবং মহাভারতকার যদি এইরূপ আলোচনা না করিতেন তবে ধর্মাধর্মের এই বৃহৎ সংগ্ৰহ কিংবা পঞ্চম বেদ সেই পরিমাণেই অপূর্ণ থাকিয়া যাইত । এই ক্ৰটী পূর্ণ করিবার জন্যই ভগবদ্গীতা মহাভারতের মধ্যে সন্নিবেশিত হইয়াছে । সত্যসত্যই ইহা আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, এই কর্মযোগশাস্ত্রের সমর্থনা করিতে বেদান্তশাস্ত্রের সমানই ব্যবহারেতেও অত্যন্ত নিপুণ মহাভারতকারের ন্যায় এক উত্তম সৎপুরুষকে আমরা লাভ করিয়াছি । এইরূপে সিদ্ধ হইল যে, বর্তমান ভগবদ্গীতা প্ৰচলিত মহাভারতেরই এক অংশ
WhatsApp%2BImage%2B2020-07-03%2Bat%2B9.28.39%2BAM

গীতা  অর্থ হলো ‘গান’, গীত থেকে গীতা। ষাট রকমের গীতার উল্লেখ আছে আমাদের পুরাণেযেমন
গুরু গীতাঃ মহাদেব শিব  পার্বতীর কথোপকথন এখানে রয়েছে। শিব  পার্বতী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেনযে একজন মানুষের অন্তরাত্মার জাগরণের জন্য সঠিক গুরুর প্রয়োজনএবং সেই গুরুর মাহাত্ম্য। এর উল্লেখ স্কন্দ পুরাণে আছে।
অষ্টবক্র গীতাঃ এখানে রাজা জনক  অষ্টবক্র ঋষির কথোপকথন রয়েছেএখানে অদ্বৈত বেদান্তের ব্যাপারে বলা হয়েছেমানুষের মধ্যের সম্পর্কআত্মশুদ্ধির বিষয়েও বলা রয়েছে। মহাভারতের বন পর্বে এর উল্লেখ আছে।
অভধুত গীতাঃ ঋষি দত্তাত্রেয়  স্কন্দ বা দেবতা কার্তিকের মধ্যের কথোপকথন। জীবনের উপলব্ধির ব্যাপারে এখানে আলোচনা রয়েছে।
ভগবৎ গীতাঃ শ্রীকৃষ্ণ  অর্জুনের কথোপকথনযেটা সবথেকে জনপ্রিয়যা জীবনের নানা সমস্যার সমাধানের কথা বলে থাকে।
অণু গীতাঃ  এটাও শ্রীকৃষ্ণ  অর্জুনের মধ্যে কথোপকথনযখন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করেনপুনরায় ভগবৎ গীতা শোনাতেকারণ তিনি বেশিরভাগই ভুলে গেছেন।
ব্রহ্ম গীতাঃ ঋষি বশিষ্ট  শ্রী রামের মধ্যে কথোপকথন। জীবনের নির্বাণের বিষয়এবং ব্রাহ্মণের আচরণ কেমন হওয়া উচিতএবং কিভাবে অন্তরাত্মার জাগরণ ঘটবে সেই বিষয়ে আলোচনা।
জনক গীতাঃ রাজা জনকের স্বগতোক্তি রয়েছে এখানে
প্রথম রাম গীতাঃ শ্রীরাম  শ্রীলক্ষণের মধ্যে কথোপকথনবিষয়অদ্বৈত বেদান্ত এর বিভিন্ন দিকযেখানে জীবঅভিদ্যঈশ্বরমায়াএসবের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
দ্বিতীয় রাম গীতাঃ শ্রীরাম  হনুমানের মধ্যে কথোপকথনযেখানে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে জগত থেকে নিবৃত্তির নিবারণের বিষয় বর্ণিত।
ঋভু গীতাঃ ঋষি ঋভু  তার শিষ্য নিদঘের মধ্যে কথোপকথন। শিব পুরাণের উপপুরাণ শিব রহস্য পুরাণের মূল আধার এটি।
সিদ্ধা গীতাঃ রাজা জনকের সামনে বিভিন্ন সিদ্ধ্য ঋষির জ্ঞানের বিস্তারযেখানে মূলত অনন্তের মধ্যে নিজের আত্মার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ের আলোচনা রয়েছে।
উত্তরা গীতাঃ ভগবৎ গীতার পরবর্তী অংশযেটা ব্রাহ্মান্ড পুরাণে বর্ণিত আছে।
বক গীতাঃ দেবরাজ ইন্দ্র এবং ঋষি বকের মধ্যে জগতের নানা কষ্টের বিবরণ।
ভিক্ষু গীতাঃ যেখানে শ্রীকৃষ্ণ একজন লোভী ব্রাহ্মণের রূপে এসে উদ্ধব কে শিক্ষা দেন।
গোপী গীতাঃ যেখানে শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিয়োগের সময় গোপিনীদের গান রয়েছেযা ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণের একটা দৃষ্টান্ত বলা যায়।
উদ্ধব গীতাঃ রাজ হাঁস রূপী বিষ্ণু ব্রহ্মার তিন পুত্রের মধ্যে কথোপকথনযা হংস গীতা বলেও পরিচিত।
এছাড়াও কপিলা গীতানহুষ গীতানারদ গীতাপাণ্ডব গীতাঋষভ গীতাশৌনক গীতাশ্রুতি গীতাইত্যাদির উল্লেখ আছে। তাহলে কোনটা কে আমরা ধর্মগ্রন্থ বলবো?

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা


নং

গ্রন্থ

লেখক/প্রকাশক

ডাউনলোড লিংক

০১শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথশ্রীল প্রভুপাদ, ইসকনডাউনলোড
০২শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাশ্রীধর স্বামীডাউনলোড
০৩গীতা গ্রন্থাবলীউপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ডাউনলোড
০৪বাংলা গীতা ও অনুগীতাবিপিনবিহারী মণ্ডলডাউনলোড
০৫শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকৃষ্ণপ্রসন্ন সেনডাউনলোড
০৬যথার্থ গীতাস্বামী অড়গড়ানন্দডাউনলোড
০৭শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড-১রামদয়াল মজুমদারডাউনলোড
০৮শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড-২রামদয়াল মজুমদারডাউনলোড
০৯শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড-৩রামদয়াল মজুমদারডাউনলোড
১০গীতা পরিচয়রামদয়াল মজুমদারডাউনলোড
১১গীতার বাণীঅণিল বরন রায়ডাউনলোড
১২অর্জুন গীতাডাউনলোড
১৩শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড-৩স্যান্যাল ভুপেন্দ্রনাথ, নারায়ণ দাসডাউনলোড
১৪শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাস্বামী কৃষ্ণানন্দডাউনলোড
১৫গীতা সার সংগ্রহস্বামী প্রেমেশানন্দডাউনলোড
১৬পরম কল্যাণ গীতানরেন্দ্রনাথ সেনডাউনলোড
১৭শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাশ্রীকৃষ্ণানন্দ স্বামীডাউনলোড
১৮কিশোর গীতাJagadiswaranandaডাউনলোড
২০গীতা মাধুকরীবঙ্কিম চন্দ্র সেনডাউনলোড
২১শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাঅনিলচন্দ্র ঘোষডাউনলোড
২২শ্রীমদ্ভগবদ্গীতানারায়ণ দাস ভক্তিসুধাকরডাউনলোড
২৩শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাপ্রসাদ দাস গোস্বামীডাউনলোড
২৪ভগবদ্গীতাশ্রীগীরিন্দ্রশেখর বসুডাউনলোড
২৫উপনিষদ রহস্য বা গীতার যৌগিক ব্যাখ্যাবিজয় কৃষ্ণ দেব শর্মাডাউনলোড
২৬শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা/গীতা মাধুকরীআশুতোষ দাসডাউনলোড
২৭শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন সংবাদবটকৃষ্ণ চক্রবর্তীডাউনলোড
২৮শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকৈলাস চন্দ্র সিংহডাউনলোড
২৯গীতানুবচন খণ্ড ১-২-৩শ্রী অনির্বাণডাউনলোড
৩০অরবিন্দের গীতা ১শ্রী অরবিন্দডাউনলোড
৩১অরবিন্দের গীতা ২শ্রী অরবিন্দডাউনলোড
৩২অরবিন্দের গীতা ৩শ্রী অরবিন্দডাউনলোড
৩৩শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড ১Srila Baladeva Vidyabhushana, Srila Bhaktivinode Thakuraডাউনলোড
৩৪শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড- ২Srila Baladeva Vidyabhushana, Srila Bhaktivinode Thakuraডাউনলোড
৩৫শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা খণ্ড ৩Srila Baladeva Vidyabhushana, Srila Bhaktivinode Thakuraডাউনলোড
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]